মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
একান্ত সাক্ষাৎকারে জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো

এখনকার কোম্পানিগুলোর সুরক্ষা ছাড়া নতুন বিনিয়োগ আসবে না

জুলকার নাইন

এখনকার কোম্পানিগুলোর সুরক্ষা ছাড়া নতুন বিনিয়োগ আসবে না

নাওকি ইতো

জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো মনে করেন, বর্তমানে ব্যবসা করতে থাকা কোম্পানিগুলোর সুরক্ষা ছাড়া নতুন বিনিয়োগ আসবে না। এজন্য ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলোর যত্ন নেওয়ার বিকল্প নেই। এ ছাড়া নতুন বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ধারণাগত সূচকগুলোর উন্নতি করতে হবে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, ট্যাক্সেশন ও অনুমোদন লাভের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে। গতকাল ঢাকার জাপান দূতাবাসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো বলেন, বর্তমানে ৩০০ জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে। গত ১০ বছরে এ সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। সংখ্যা ক্রমেই আরও বাড়ছে। জাপানের বেশ কিছু বড় করপোরেট কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইছে। গত বছর জাপান টোব্যাকো বাংলাদেশে বৃহত্তম বিনিয়োগ করেছে। তবে বড় বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের প্রয়োজন। সর্বপ্রথম প্রয়োজন অবকাঠামোর উন্নয়ন। প্রয়োজন সাপ্লাই চেইনের কাঠামো উন্নয়ন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও জাপান যৌথভাবে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, কয়েকটি সেতু প্রকল্প, মাতারবাড়ীতে বন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মতো প্রকল্প ইতিমধ্যে চলছে। এ ছাড়া যৌথভাবে বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, মাতারবাড়ী প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের একটি স্বপ্নের প্রকল্প। এর মাধ্যমে এ অঞ্চলকে নতুন একটি সিঙ্গাপুরে পরিণত করা হবে। জাপান অত্যন্ত খুশি যে, বাংলাদেশ তার এমন একটি প্রকল্পের জন্য জাপানের সহায়তা চেয়েছে। মাতারবাড়ী শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাউথ এশিয়া ও সাউথ এশিয়ান দেশগুলোর জন্য অন্যতম সংযোগ হাব হবে মাতারবাড়ী। এসব কারণে মাতারবাড়ীর সফল বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি ট্যাক্সেশন, ক্রস বর্ডার ট্রেড, কমপিটেটিভ পলিসি, ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস এসব ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে অবকাঠামোগুলো হয়তো হয়ে যাবে। তখন অর্থনীতিও বড় হবে। তখন কিন্তু ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশের ক্ষেত্রে অন্য যেসব আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন হয় সেগুলোতে বিদ্যমান থাকা সংকটগুলোও তীব্র আকার ধারণ করবে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস র‌্যাংকিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলোয় উন্নয়ন করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। এ ধরনের র‌্যাংকিং বাংলাদেশের বাইরে থেকে যারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তাদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব রাখে।

জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো বলেন, যদি আমরা আরও বেশি বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ প্রত্যাশা করি, তাহলে অবশ্যই বর্তমানে বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলোর যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। যারা ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করেছে তারা যদি সঠিক সুরক্ষা না পায় তাহলে নতুন কেউ আসবে না। নতুনরা ধারণা নেয় পুরনোদের কাছ থেকেই। তারা যদি সঠিকভাবে কিছু উত্থাপন না করে তাহলে নতুন বিনিয়োগ আসবেই না। বাংলাদেশে নতুন করা অর্থনৈতিক জোনগুলোয় বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পুরনো ইপিজেডগুলোয় থাকা কোম্পানিগুলোর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ইপিজেডে বেশ কিছু জাপানি কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ২৯ বছরের পুরনো কোম্পানিও আছে। কিন্তু এত দিন ধরে ব্যবসা করেও এসব কোম্পানির সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তারা প্রায়ই ট্যাক্সেশন, প্রয়োজনীয় আমদানির অনুমোদন লাভে ধীরগতি, শ্রমিকদের বেতনকাঠামোর পার্থক্যসহ নানা ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্টস ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো নতুন মার্কেটে রপ্তানির ক্ষেত্রে ক্যাশ ইনসেনটিভ পাচ্ছে। বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ক্যাশ ইনসেনটিভের অযোগ্য থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের বিষয়গুলোর একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০২৪-এ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের কাঠামো থেকে বের হয়ে আসতে যাচ্ছে। তখন বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। তখনকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করার প্রয়োজন হবে অনেক বেশি। এজন্য দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়াসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা দেশের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের এখনই কাজ করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমার থেকে দেশ ছেড়ে আসা মানুষগুলোর জন্য বাংলাদেশ যা করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ যেভাবে ক্যাম্পগুলো ম্যানেজ করছে, যেভাবে সবার খাদ্য নিশ্চিত করা হচ্ছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এটা মানবিকতার এক সফল উদাহরণ। এই সাকসেস স্টোরি অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব সহায়তা করতেই জাপান প্রস্তুত। অবশ্যই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরেকটি জরুরি বিষয়। এ ক্ষেত্রে তেমন একটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যাশামতো যে কোনো সহায়তা ও অবস্থানের জন্য জাপান সরকার প্রস্তুত আছে। বাংলাদেশ থেকে জাপানে শ্রমশক্তি রপ্তানির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ থেকে কনস্ট্রাকশন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, নার্সিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত কর্মী নিতে জাপান আগ্রহী। এজন্য গত আগস্টের শেষে একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর জাপান সফরে এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে নতুন এই সহযোগিতার ক্ষেত্র নিয়ে মাত্র আলোচনা শুরু হয়েছে। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই তা পূর্ণ মাত্রা পাবে।

জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ ও জাপান এ মুহূর্তে চমৎকার সম্পর্ক উপভোগ করছে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে জাপান দেশটির পাশে আছে। সে হিসেবে জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও স্থায়ী বন্ধু। প্রতি বছর জাপান বাংলাদেশকে ৩০০ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন সহায়তা দেয়। ভারতের পর বাংলাদেশই বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাপানি সহায়তাপ্রাপ্ত দেশ। বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রসরমাণ অর্থনীতির প্রয়োজনে তৈরি হতে থাকা বিভিন্ন বড় অবকাঠামোর জন্য জাপানের এ সহায়তা বড় ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ-জাপানের এ সম্পর্ক নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ জাপান সফরে সম্পর্কের এই আশাবাদ আরও প্রবল হয়েছে। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে আমি চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো জাপান ফেস্ট আয়োজন করা হয়। জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে আসা বাংলাদেশিদের উপস্থিতি সেখানে নজর কেড়েছে। শুধু তারাই নয়, চট্টগ্রামের তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের জাপানের সংস্কৃতি ও জাপানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ ছিল দেখার মতো। তাই আমি মনে করি বাংলাদেশ ও জাপানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দুই দেশের জনগণের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর