সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ফিরে দেখা ২০১৯

সংসদে যোগদান, খালেদা জিয়ার মুক্তিতে নরম কর্মসূচি বিএনপির

মাহমুদ আজহার

২০১৯ সালও ভালো কাটেনি বিএনপির। প্রায় দুই বছর ধরে কারাবন্দী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখনো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন না। তার মুক্তি দাবিতে জোরালো কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি দলটি। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে রাজপথের ‘নরম’ কর্মসূচিতেই বছর কেটেছে দলটির। এর মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল দলীয় এমপিদের শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ায় আলোচনায় আসে বিএনপি। এ বছরের শেষদিকে পরপর দুই সিনিয়র নেতার পদত্যাগ, বিএনপি জোট থেকে আন্দালিভ রহমান পার্থের বেরিয়ে যাওয়া, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বেরিয়ে যাওয়া, জামায়াতকে নিয়ে ২০-দলীয় জোটের শরিক দল এলডিপির জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠন নিয়েও বিএনপির ভিতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। গত এক বছরে সাংগঠনিকভাবেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে প্রায় অর্ধেক জেলায় আহ্বায়ক কমিটি করলেও যথাসময়ে হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। বিএনপির সাংগঠনিক ‘প্রাণ’ বলে খ্যাত জাতীয়তাবাদী যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। আংশিক কমিটি দিয়েই তারা মেয়াদ পার করেছে। একই অবস্থা ঢাকা মহানগর বিএনপিরও। দুই শাখায় আংশিক কমিটি দিয়ে চলছে বছরের পর বছর। ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে এমনকি মহানগর দুই শাখায় নেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি। জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, ওলামা দল, তাঁতী দল ও মৎস্যজীবী দলও নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড। অবশ্য এরই মধ্যে কাউন্সিলে নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দুই নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে আংশিক কমিটিও ঘোষণা হয়েছে। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাও নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বিএনপির সিনিয়র দুই নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান এম মোর্শেদ খানের পদত্যাগে দলের ভিতরে-বাইরে তুমুল আলোচনা হয়। এর আগেও বিএনপি থেকে মোসাদ্দেক আলী ফালু, আলী আসগর লবী, শাহাবুদ্দিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন নেতা দল ছাড়েন। এ ছাড়া অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাসহ কয়েক নেতার মৃত্যুতেও শোকাহত ছিল দলটি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নানা প্রতিকূল পরিবেশে বিএনপি আজ শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে আছে-এটাই বড় সফলতা। এটা সত্য যে, আমরা আমাদের দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে পারিনি। কিন্তু আমরা রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছি। বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা আজ মামলা-হামলায় জর্জরিত। গত দশ বছরে বিএনপির অন্তত ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা  দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী গুম হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকনির্দেশনায় আমরা আমাদের সাংগঠনিক কর্মকা  চালিয়ে যাচ্ছি।’ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সর্বাত্মক কর্মসূচি দিয়েছি। তবে বেগম জিয়ার মুক্তি দাবিতে আমরা দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। তারপরও রাজপথের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। বিএনপিপ্রধানের মুক্তি দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে অন্তত ৬০টির মতো কর্মসূচি পালন করেছি। এ ছাড়াও আমি নিজে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর অন্তত ৪০টি স্পটে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছি। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার পাশাপাশি বেগম জিয়ার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে কঠোর কর্মসূচিতে যাব।’ বিএনপিসহ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বেগম জিয়ার জামিনে মুক্তি প্রসঙ্গ। সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালতেও জামিন পাননি খালেদা জিয়া। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দি ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ  হোসেনের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে এই আদেশ দেয়। তবে আদালত খালেদা জিয়ার সম্মতি নিয়ে মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব  মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ  দেয়। এ প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আদালত জামিন দেবেন। কিন্তু তা দেননি। এটা নজিরবিহীন। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের জন্য এটা কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির এখনো সংকট গভীরতর। কিন্তু তা দূর করার সামর্থ্য নেতাদের নেই। দলের অভ্যন্তরেও কাটেনি সংকট। নেতৃত্বে চেইন অব কমান্ড এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। দল সাংগঠনিকভাবে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়ায়নি। নির্ধারিত সময়ে করতে পারেনি কাউন্সিল। দুর্বল নেতৃত্বের কারণে বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। হতাশ তৃণমূলকে আশ্বস্ত করার মতো কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেনি দলটি। জনদাবি নিয়ে আন্দোলনে যেতে পারেনি বিএনপি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, মানবাধিকার কমিশনে দুর্বল ভূমিকা পালন, মাদকযুদ্ধে কয়েকশ লোকের মৃত্যু, ৩০ লাখের বেশি মামলাজট, সড়কে প্রতিদিন ২০ জনের বেশি মানুষের লাশ হওয়া, খাদ্যে ভেজাল, ভঙ্গুর অর্থনীতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, যানজট, ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া, পুঁজিবাজার ধ্বংস করে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করা, লাখো শিক্ষিত  বেকারের চাকরি না হওয়া, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি যে এখন কোন পথে তা আল্লাহই ভালো জানেন। তারা না জনগণের দাবিগুলো নিয়ে মাঠে সরব ছিল, না তাদের নেত্রী বেগম জিয়ার মুক্তি দাবিতে মাঠে ছিল। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নেতারাই হয়তো বেগম জিয়ার মুক্তি চান না। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত থাকলেও বিএনপি কোনো কর্মসূচি দিতে পারে না। তাদের কোনোভাবেই বিরোধী দল বলা যাবে না।’

সর্বশেষ খবর