মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ফিরে দেখা ২০১৯

দ্রুতগতির অর্থনীতিতে আচমকা হোঁচট

মানিক মুনতাসির

টানা ১১ বছর ধরে একই মতাদর্শের সরকার দেশ শাসন করায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ হয়ে আসছিল বেশ দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও উচ্চ। মাথাপিছু আয়ও দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি আর বিশ্বমন্দার বাড়তি মাত্রা যোগ হওয়ায় বছরের শেষ দিকে এসে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা সামষ্টিক অর্থনীতি আচমকা হোঁচট খেয়ে বসেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রায় টানা এক দশক ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে ৫ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে নতুন এক অধ্যায় শুরু করে বাংলাদেশ। সব শেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। ২০২২ সালের আগেই ডাবল ডিজিট (দুই অঙ্ক) প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একইভাবে ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৭০৯ মার্কিন ডলার। এখন সেটা ১৯০০ ডলার অতিক্রম করেছে। সে সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৩২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। রপ্তানি ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে তা ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগামীতে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। স্থায়ী কর্মসংস্থানে খুব একটা আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হলেও অস্থায়ী কর্মসংস্থান, বিকল্প কর্মসংস্থান এবং কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে কর্মক্ষম মানুষ আর শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে সরকার। একইভাবে প্রবাসী আয়, আমদানি, স্থানীয় বিনিয়োগ, বিশেষ করে সরকারি বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ, বাজেট বাস্তবায়ন, রাজস্ব আদায়সহ সব কটি সূচকে টানা কয়েক বছর ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু চলতি বছরের শেষ দিকে এসে একমাত্র প্রবাসী আয় ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির সবগুলো সূচকই নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির এ অবস্থাকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলা অর্থনীতির মাঝপথে আচমকা হোঁচট খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। এদিকে গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের বছর শেষের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে চলমান শৈত্যপ্রবাহের প্রকোপ সামষ্টিক অর্থনীতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। বছরজুড়ে দেশের অর্থনীতি নানা সমস্যায় জর্জরিত থেকেছে। বিনিয়োগেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। ব্যাংক খাতেও তারল্য সংকট ঘনীভূত হয়েছে। এখনো প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। গত বছরের মতো বিদায়ী বছরও বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বজায় ছিল। বিদায়ী বছরে বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে ৬ লাখ ৪ হাজার ৬০ জনের। যা গত বছর হয়েছিল ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯৬২ জনের। দারিদ্র্যের হার কমেছে কিন্তু সেটা উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অন্যদিকে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, পুঁজির অবাধ পাচার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতার মধ্যে অসমতা বাড়ছে হু হু করে।

জানা গেছে, চলতি বছর রেকর্ড প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও বেসরকারি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত গতি পায়নি। দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে দ্রুতগতিতে। কিন্তু সেটি সন্তোষজনক নয়। এখনো দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ দরিদ্র। প্রবাসী আয় বেড়েছে। কিন্তু বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা কমেছে। আমদানি ব্যয় বেড়েছে কিন্তু শিল্পের মূলধনি আমদানি কমেছে।

আরও আশঙ্কার কথা হচ্ছে, বিশ্বজুড়েই এখন আর্থিক মন্দা চলছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের দেশ ভারতের অর্থনীতির গতিও শ্লথ হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর দ্রুতগতিতে ছোটার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিও কিছুটা হোঁচট খেতে বসেছে। নতুন বছরে তাই মন্দার আভাস দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে ২০১০ সালের বিশ্ব অর্থনীতির মহামন্দায়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।’ ফলে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টি ও বিশ্ববাজারের চলমান অবস্থান ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ হয়তো তেমন কোনো আঘাতের মুখে পড়বে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি-বাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে গেছে। এত দিন আমদানি বাড়ার প্রবণতা ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে গেছে। যা কিছু আমদানি হচ্ছে এর মধ্যে খাদ্যপণ্যই বেশি। সার্বিক আমদানির পাশাপাশি শিল্প খাতে বিকাশের প্রধান উপকরণ মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও অনেক কমে গেছে। রপ্তানি খাতেও বিরাজ করছে মন্দা পরিস্থিতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কম রপ্তানি হয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের পণ্য। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭০৭ কোটি ডলারের পণ্য। এর ফলে তৈরি হচ্ছে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলারে। বাধার মুখে পড়েছে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নও। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। রাজস্ব খাত থেকে কাক্সিক্ষত পরিমাণে আয় না হওয়ায় ব্যয়ের অর্থের সংস্থান করতে সরকারকে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করতে হচ্ছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে আসছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সরকার ৪৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ধার হিসেবে নিয়ে ফেলেছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংক খাত থেকে বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে অনেক কম। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৬৪ শতাংশ। ঋণ ও আমানতের সুদহার হবে নয়-ছয় শতাংশ- সরকার এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়ছে। এ মুহূর্তে এ ধরনের চাপ সামাল দিতে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর