মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ফিরে দেখা ২০১৯

সমালোচনা, এনআইডি কাণ্ড অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে ইসি

গোলাম রাব্বানী

একাদশ জাতীয় সংসদ, সিটি-উপজেলাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি, অনিয়ম, অস্বাভাবিক ভোট পড়ার হার নিয়ে বছরজুড়ে কঠোর সমালোচনার মুখে ছিল নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়া সিইসি-সচিব ও নির্বাচন কমিশনারদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সমালোচনার ঝড় তুলে ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা নারীর এনআইডি পাওয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসে লাখ টাকার বিনিময়ে কীভাবে জাল এনআইডি পায় রোহিঙ্গারা। দালাল চক্রের সঙ্গে ইসির কর্মচারীর পাশাপাশি কর্মকর্তাদের নামও আসে আলোচনায়। জালিয়াত চক্রের খোঁজে মাঠে নামে ইসি, পুলিশ, দুদক টিম। আলোচনা-সমালোচনা পেছনে ফেলে নিবন্ধিত দলগুলোর অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটার উপস্থিতি ও অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ ভাগ। এ নির্বাচনের সমালোচনা মাথায় নিয়ে বছর শুরু করে নির্বাচন কমিশন। এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু বিষয় নতুন ঘটেছে। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ৬টি আসনে, নিবন্ধিত সব দলই অংশ নেয় ৩৯টি দল এবং শতভাগ ভোট পড়ে শতাধিক কেন্দ্রে। সংসদ নির্বাচনে ‘বেশকিছু কেন্দ্রে’ শতভাগ ভোট পড়া ‘অস্বাভাবিক’ হলেও গেজেট প্রকাশের পর এ নিয়ে কমিশনের কিছু করার নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন সিইসি। ওই ভোট শেষে ‘স্বস্তি’ দেখালেও বছরের বিভিন্ন সময়ে একজন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সরব। ৩০ ডিসেম্বর ভোটের ফল ঘোষণার পর বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ তুলে  পুনর্নির্বাচনের দাবি জানায়, যা সিইসি পরদিনই নাকচ করে দেন। ভোটের দুই দিন পর ইসির ফোয়ারা চত্বরে ‘ধন্যবাদ জ্ঞাপন’ অনুষ্ঠান আয়োজনে পিঠা উৎসবের; ভবনের জলাশয়ে বরশি দিয়ে মাছ শিকার করে তার বার-বি-কিউ করে খাওয়া হয়। কমিশনের নানা বিষয়ে সরব থাকা নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ৩ জানুয়ারির এ অনুষ্ঠানে সিইসির ‘স্তুতি’ করেন এভাবে, “তিনি (সিইসি) একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং যোদ্ধার মতোই তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সবাইকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় মেয়র পদে উপনির্বাচন হয়। এতে সব দলের অংশগ্রহণ না হওয়ায় ছিল কমিশনের ‘অস্বস্তি’। সিইসি বলেছিলেন, দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নেওয়া আমাদের প্রতি অনাস্থা নয়। তবে সব দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া আমাদের জন্য অস্বস্তিকর।’’ মাহবুব তালুকারও জানান, প্রধান বিরোধী দলগুলো এতে অংশগ্রহণ না করায় এটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তাতে ভোটারদের উৎসাহ দেখা যায় না। এরপর মার্চে পাঁচ দফায় ভোট হয় উপজেলা পরিষদে। এতে বিএনপির বর্জনের মধ্যে শতাধিক উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ভোট পড়ে গড়ে ৪০%। উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব নিয়ে নানা অভিযোগের মধ্যে নাকাল ছিল কমিশন। মার্চে রাঙ্গামাটিতে ভোট শেষে ব্রাশ ফায়ারে সাতজনের প্রাণ গেছে। এ পরিস্থিতিতে ভোটের ‘জৌলুস ও কৌলিন্য’ হারাচ্ছে মন্তব্য করেন মাহবুব তালুকদার। সব শেষ বছরের শেষ দিকে তিন সিটি নির্বাচন নিয়েও তিনি সমালোচনা করেন। সর্বশেষ তিনি ২৫ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনের ৩ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। বাকি দুই বছর সময়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনকে নিয়ে রাজধানীবাসীর ঔৎসুক্য, উদ্বেগ অন্তহীন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও জাতীয় নির্বাচনের মতোই এতে সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে যেসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে, তাতে প্রথম কুমিল্লা ও রংপুর সিটি নির্বাচনে আমাদের সফলতা ছিল। বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়।’

দ্বন্দ্বে নিজেরাই : নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন হওয়ার ‘একক কর্তৃত্ব’ নিয়ে এক দশক ধরে দ্বন্দ্ব ছিল কমিশনে। সিইসি ও সচিবের এ কর্তৃত্বকে নিয়ে নির্বাচন কমিশনাররা ‘কিছুটা’ নীরব থাকলেও এবারের কমিশন বেশ সরব। ‘নিয়োগ’ প্রক্রিয়া নিয়ে সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গণমাধ্যমে ব্রিফিং করে ইসি সচিবালয়ের বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ করেন।

পাল্টা জবাবে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর সব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নির্বাচন কমিশনারদের ‘অবগত’ করার বিষয় নয়’। যা হয়েছে তা হানড্রেড পার্সেন্ট আইনসম্মত। সংবিধান, আইন, বিধি ও নিয়মকানুন ফলো করে করা হয়েছে। এ নিয়োগে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর কমিশন সভায় চার নির্বাচন কমিশনার লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন। সিইসির উপস্থিতিতে উষ্মা প্রকাশ করেন তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একজন নির্বাচন কমিশনার প্রত্যাশা রাখেন, সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি সব সময় সংবিধানসহ বিদ্যমান সব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে এটাই কাম্য। সিইসি সব নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিদ্যমান সব আইন অনুসরণ করে কমিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কমিশনে মতপার্থক্য থাকলেও কোনো বিভেদ নেই বলে দাবি করেন ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর। এ ছাড়া গেল নভেম্বর ফের চার নির্বাচন কমিশনার ‘একাট্টা’ হয়ে সিইসি ও সচিবের ‘একক কর্তৃত্ব’ বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন এ নির্বাচন কমিশনাররা। বছর শেষে ইসি সার্বিক কর্মকান্ড নিয়ে জাতি ‘বিব্রতকর’ বলেও মন্তব্য করে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি।

রোহিঙ্গাদের এনআইডি : এপ্রিল থেকে দেশজুড়ে শুরু হয় ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার এক যুগে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সব সময় সতর্ক অবস্থানে ছিল ইসি। স্মার্টকার্ড দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে সংশ্লিষ্টদের আরও কড়া হুঁশিয়ারি দেয় সাংবিধানিক সংস্থাটি। এরই মধ্যে আগস্টে এক রোহিঙ্গা নারীর এনআইডি পাওয়াকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসে লাখ টাকার বিনিময়ে কীভাবে জাল এনআইডি পায় রোহিঙ্গারা। দালাল চক্রের সঙ্গে ইসির কর্মচারীর পাশাপাশি কর্মকর্তাদের নামও আসে আলোচনায়। জালিয়াত চক্রের খোঁজে মাঠে নামে ইসি, পুলিশ, দুদক টিম। এনআইডি জালিয়াতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ের এক অফিস সহায়ককে দুই সহযোগীসহ আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে ইসির চুরি যাওয়া একটি পুরনো ল্যাপটপ জব্দ করে পুলিশে দেন কর্মকর্তারা।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য : প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১০ বছর ধরে। কিন্তু নানা জটিলতায় কমিশন তা করে উঠতে পারছিল না। ছবিসহ ভোটার তালিকা শুরু থেকে এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ও কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়েছিল। সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা কমিশন সিঙ্গাপুর থেকেই নিবন্ধন কাজ শুরুর কাজ গুছিয়ে এনেছিল। তবে শেষমুহূর্তে আর কাজ শুরু করা যায়নি। সব জটিলতা পেরিয়ে অবশেষে গেল ৫ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য অনলাইন ভোটার নিবন্ধন সেবা চালু করা হয়।

সর্বশেষ খবর