বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

২০ লাখের বাড়ি ৩২ লাখ ডলারে

লস অ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশ মিশনের বাড়ি কেনা নিয়ে বিতর্ক

জুলকার নাইন

২০ লাখের বাড়ি ৩২ লাখ ডলারে

লস অ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশ মিশনের ভবন ছবি : গুগল স্ট্রিট ভিউ

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশের স্থায়ী কনস্যুলেট অফিস ও কনসাল জেনারেলের স্থায়ী বাসভবন কেনায় তুঘলকি কান্ড ঘটেছে। রহস্যজনকভাবে প্রচলিত মূল্যের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে পরিত্যক্ত এ দুই বাড়ি। এখন বাড়ি দুটোর পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক ব্যয়ের তুলনায় দ্বিগুণ ব্যয় দেখানো হচ্ছে। এ দুই বাড়ির লোকেশন নির্ধারণও হয়েছে বাংলাদেশি কমিউনিটির অবস্থান থেকে দূরে। যেখানে সাধারণের প্রবেশেই রয়েছে নানান ধরনের নিষেধাজ্ঞা এবং নেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সদ্য সাবেক কনসাল জেনারেল প্রিয়তোষ সাহা এ দুই অফিস ও বাড়ি উচ্চমূল্য দেখিয়ে কেনার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা প্রিয়তোষ সাহা রাজনৈতিক আনুকূল্যে লস অ্যাঞ্জেলেসে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন শেষে অতি সম্প্রতি ঢাকা ফেরেন।

সরকারের তথ্য মতে, লস অ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশ কনসাল জেনারেলের বাসভবনের জন্য সেখানকার ভিউপার্ক এলাকার কেনওয়ে এভিনিউতে ৩৯৪৪ নম্বর বাড়ি গত ৮ আগস্ট কেনা হয়েছে ৩২ লাখ মার্কিন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান জিলোর তথ্য মতে, ৩৯৪৪ কেনওয়ে এভিনিউয়ের এই বাড়ির সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য ছিল ২০ লাখ ৪৫ হাজার ৫৫৭ মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত জিলোর সম্ভাব্য বিক্রয়মূল্যের তুলনায় কম দামে বাড়ি কেনা-বেচা হলেও বাংলাদেশ সরকারের জন্য এই বাড়ি কেনা হয়েছে সম্ভাব্য মূল্যের চেয়ে ১২ লাখ মার্কিন ডলার বেশি দিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতে ক্রয়-বিক্রয়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান রিয়ালটর ডট কমে দেখা যায়, ভিউপার্কে কেনওয়ে এভিনিউতে বাংলাদেশের কেনা বাড়িটি মোট ১৬ হাজার ৯৬৭ স্কয়ার ফুট জায়গার (লট)-এর ওপর ৩ বেডরুম ও ৫ বাথরুমের ৫ হাজার ৫৪ বর্গফুটের একটি অবকাঠামো (বিল্ডিং) রয়েছে।

রিয়ালটরে দেখানো তথ্যে, ভিউপার্কে এই ধরনের মাপের কোনো বাড়ির ১৪ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যে বিক্রি হয়নি। রিয়ালটর বলছে, এভিনিউতে মাত্র চারটি বাড়ি পরে ৩৯২১ কেনওয়ে এভিনিউতে ২১ হাজার ৪১ বর্গফুটের ওপর ৬ হাজার ১৪ বর্গফুটে ৫ বেড ও ৫ বাথরুমের ভবন বিক্রি হয়েছে ১৪ লাখ মার্কিন ডলারে। পাশেরই ৪০১৬, কেনওয়ে এভিনিউতে ২০ হাজার ৫৪৯ বর্গফুট জায়গার ওপর ৩ বেড ৪ বাথের আরেকটি বাড়ি বিক্রি হয়েছে ১৩ লাখ মার্কিন ডলারে। একই লোকেশনের ব্যবহার উপযোগী এ বাড়িগুলোর প্রতিটিই বাংলাদেশের কেনা পরিত্যক্ত বাড়ির চেয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার বর্গফুট বড় জায়গার ওপর নির্মিত। অথচ বাংলাদেশের কেনা বাড়ি ওই দুই বাড়ির চেয়ে ১৮ লাখ ও ১৯ লাখ মার্কিন ডলার বেশি দাম দেখিয়ে কেনা হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসের সাউথ ফেয়ারফক্স এভিনিউ-এর ৫০১ নম্বর বাড়িটি কেনা হয়েছে ৮৩ লাখ ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন ক্রয় বিক্রয়ের ট্যাক্স আদান-প্রদানের ও নাম জারির প্রতিষ্ঠান ফাস্ট আমেরিকানের তথ্য মতে, এই সম্পত্তি গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশের নামে রেকর্ড করা হয়। অবশ্য প্রপার্টির মালিকের নাম লেখা ‘গভর্নমেন্ট অব পিপলস রিপাবলিক অব বাংলা’। বাংলাদেশ শব্দের পরিবর্তে ভুলক্রমে বাংলা লেখা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অফিস ভবন ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার গত ৬ মার্চ ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে। অবশ্য ফাস্ট আমেরিকানের তথ্য মতে, গত বছর ২০১৮ সালে ট্যাক্স পরিশোধের সময় পরিত্যক্ত এই ভবনের মূল্য দেখানো হয় ৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এই মূল্য দেখিয়ে ৫ হাজার ৭০৩ ডলার ট্যাক্স পরিশোধ করে আগের মালিক।

জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে নির্মিত এই অফিস বিল্ডিং মিরাকল মাইলি প্রপার্টি নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার কিনে নেয়। মিরাকল মাইলি বাড়িটি ২০১৫ সালে মেনটো ট্রাস্টের কাছ থেকে কিনেছিল। মেন্টো স্যাম ট্রাস্টের নামে সম্পত্তিটি ১৯৮৪ সালে নাম জারি হয়েছিল। বাংলাদেশের কেনা এই প্রপার্টির আগের ক্রয় বিক্রয়ের মূল্য পরিশোধের আর কোনো তথ্যই ফাস্ট আমেরিকানে সংরক্ষিত নেই। ব্যবহারের বিষয়েও কোনো তথ্য নেই এখানে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের বেশ কিছু পরিত্যক্ত প্রপার্টি আছে। ক্রয়-বিক্রয়ে তেমন কারও আগ্রহ না থাকায় চাইলে সস্তায় নামমাত্র মূল্যে কেনা যায়।

বাংলাদেশের ক্রয় করা এই অফিস ভবনে মাত্র ছয়টি গাড়ি পার্কিয়ের ব্যবস্থা আছে। যেখানে কনস্যুলেট অফিসের গাড়ি পার্কিং করে তালাবদ্ধ রাখা হয়। সেবাপ্রার্থী কারও গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই এখানে নেই। সেবাপ্রার্থীদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য দুই মাইল দূরে একটি পাবলিক পার্কিং রয়েছে। যেখানে ১৬ ডলার প্রতি ঘণ্টায় পার্কিং করে বাস বা উবারে করে আসতে হবে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে। এমন এলাকায় বাংলাদেশের অফিস কেনা হয়েছে যেখানে রাস্তায় পার্কিং ফি দিয়েও গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো সুযোগ নেই।

সাউথ ফেয়ারফ্যাক্স এভিনিউতে বাংলাদেশের কেনা অফিসের পাশেই আরেকটি ভবন ১৪৫, সাউথ ফেয়ারফ্যাক্স এভিনিউয়ের মোট জায়গা বা লট সাইজ ২৩ হাজার ৮১৭ বর্গফুট। ১০৫, সাউথ ফেয়ারফ্যাক্স এভিনিউতে আরেকটি প্রপার্টির মোট জায়গা বা লট সাইজ ১১ হাজার ২৬২ বর্গফুট। এগুলোর কোনোটিরই মূল্য বাংলাদেশের পরিশোধ করা ৮৩ লাখ মার্কিন ডলারের অর্ধেকও নয়। অথচ এগুলো কোনো একটি কেনা হলে সেবাপ্রার্থীদের গাড়ি পার্র্কিংয়ের কোনো অসুবিধা থাকত না। লস অ্যাঞ্জেলেস প্রবাসীদের অভিযোগ, লস অ্যাঞ্জেলেসে স্বীকৃতি প্রাপ্ত এলাকা ‘লিটল বাংলাদেশ’-এ প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাংলাদেশির বসবাস। এ অঞ্চলেই রয়েছে চীনসহ একাধিক দেশের স্থায়ী কনস্যুলেট অফিস। এখানে চমৎকার ও মর্যাদাপূর্ণ লোকেশনে জমি না কিনে যোজন যোজন দূরে অস্বাভাবিক দামে জমি কেনার পিছনে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না প্রবাসীরা।

সর্বশেষ খবর