শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রত্যাহার ও গ্রেফতার আতঙ্ক

বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী আটক, ৪৫ কাউন্সিলর ও উত্তরে জাপার মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র বাতিল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজন

মাহমুদ আজহার ও গোলাম রাব্বানী

প্রত্যাহার ও গ্রেফতার আতঙ্ক

রাজধানীর গোপীবাগ কমিউনিটি সেন্টারে গতকাল যাচাই-বাছাই শেষে মেয়র প্রার্থীরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আচরণবিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর গোপীবাগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে নিজ ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে (বংশাল) বিএনপির সমর্থনে কাউন্সিলর প্রার্থী তাজউদ্দিন আহমেদ তাজু। মতিঝিলের ইত্তেফাক মোড় থেকে বিকাল সোয়া ৪টার দিকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি বংশাল থানা বিএনপির সভাপতি। বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন ফকির জানালেন, ‘তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনের একাধিক মামলা রয়েছে এবং কয়েকটিতে গ্রেফতারি পরোয়ানাও আছে। তাই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

জানা যায়, শুধু তাজউদ্দিনই নন, দুই সিটিতে অংশ নেওয়া বিএনপির প্রায় সব কাউন্সিলর প্রার্থীই বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার আসামি। অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। ডজন মামলার ওপরে বিএনপির প্রায় সব প্রার্থীই। ভোটের শুরুতেই তারা গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন। অন্যদিকে বিএনপিসহ স্বতন্ত্র অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন। তারা বলছেন, এরই মধ্যে ফোনে বা কেউ সরাসরি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ দিচ্ছেন লোভনীয় অফার।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করার নির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত এবং নির্বাচনী এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম-কমিশনার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি বা কোনো রাজনৈতিক দলের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের গ্রেফতার বা হয়রানি করার কোনো নির্দেশনা আমাদের নেই। তবে যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে সে ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা না নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় যদি বিএনপির প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে বোঝার বাকি থাকে না যে সরকার কী ধরনের ভোট করতে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন তো ঠুঁটো জগন্নাথ। তারা এটা দেখেও না দেখার ভান করছে। কার্যত বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়াতেই তাজউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকার চায় আমরা ভোট ছেড়ে চলে যাই। তবে গ্রেফতার-হুমকি যা-ই আসুক, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবে।’ ঢাকা দক্ষিণের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শামসুল হুদা বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি। রাজনৈতিক মামলাও আছে। এখন পুলিশ যদি আমাদের গ্রেফতার করে তাহলে বুঝতে হবে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে না। এ ছাড়া ইভিএম নিয়ে আমাদের শঙ্কা আগেও ছিল এখনো আছে। এতে জনগণের ভোটাধিকারের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নই।’

বৈধ কাউন্সিলর প্রার্থী ৯৮০ জন : ঢাকা-উত্তর দক্ষিণ সিটিতে মোট ১৪ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে একজনের মনোনয়নপত্র অবৈধ এবং ১৩ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ করেছেন রিটার্নিং অফিসার। আর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে উত্তরের জাতীয় পার্টির প্রার্থীর। তবে দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাপাসহ সাতজন মেয়র প্রার্থীই বৈধ হয়েছেন। ৪৬০ জন সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে ৪৩৪ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। বাতিল হয়েছে ২৬ জনের প্রার্থিতা। আর সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের ১০২ জন প্রার্থীর মধ্যে ১০০ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। বাতিল হয়েছে দুজনের প্রার্থিতা। ঢাকা দক্ষিণের ৮ নম্বর সংরক্ষিত (২২, ২৩ ও ২৬ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ড নিয়ে) ওয়ার্ডে একজন প্রার্থী রয়েছেন, তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এদিকে উত্তরে সাতজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ছয়জনের মনোনয়নপত্র বৈধ আর একজনের প্রার্থিতা বাতিল করেছেন রিটার্নিং অফিসার। এ ছাড়া ৩৭৪ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে বৈধ হয়েছেন ৩৫৯ জন, বাতিল হয়েছে ১৫ জনের মনোনয়নপত্র। ৮৯ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে বৈধ হয়েছেন ৮৭ জন, আর দুজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৯ জানুয়ারি, প্রতীক বরাদ্দ হবে ১০ জানুয়ারি। প্রচার শেষে ভোট হবে ৩০ জানুয়ারি।

ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে জাপার প্রার্থী ছাড়া সবাই বৈধ : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছাড়া বাকি ছয়জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। যাচাই-বাছাই শেষে গতকাল সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনআইএলজি ভবনে ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বৈধ প্রার্থীরা হলেন- আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম, বিএনপির তাবিথ আউয়াল, সিপিবির ডা. আহাম্মদ সাজেদুল হক রুবেল, পিডিপির শাহীন খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ফজলে বারী মাসউদ ও এনপিপির আনিসুর রহমান দেওয়ান। রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী জি এম কামরুল ইসলাম সিটি করপোরেশনের ভোটার নন বলে নির্বাচন কমিশন তার মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে পারেনি। মেয়র প্রার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা আচরণবিধি মেনে চলবেন। নির্বাচন হবে ফেস্টিভ মোডে। সেই জায়গা যাতে কখনোই সংঘর্ষে রূপ না নেয়। রাস্তাঘাট বন্ধ করে কোনো রকম প্রচার-প্রচারণা আপনারা চালাতে পারবেন না। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা সক্রিয় আছেন, আমি নিজেও মাঠে যাব। নির্বাচন কমিশনের কোনো দল নেই। আমাদের কাছে সব প্রার্থী সমান। শহরের নাগরিকদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় তা আপনারা দেখবেন। আচরণবিধি ভঙ্গে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রথমবারের মতো মেয়র পদে লড়তে ইচ্ছুক জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক সেনা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম। নিজেকে বৈধ প্রার্থী দাবি করে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি ডিওএইচএস এলাকায় থাকি বলে আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলো। ভোটার তালিকায় আমার ২ নম্বর ওয়ার্ড ও সিটি করপোরেশন দেখানো হয়েছে। সেহেতু আমি যোগ্য ভোটার হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। এখন আমি আইনের সহায়তা নেব।’

নির্বাচনী দায়িত্ব না দিতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চিঠি : আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব না দিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ২৬ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ অনুরোধ জানানো হয়। গতকাল ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর স্বাক্ষরিত চিঠির অনুলিপি উত্তর ও দক্ষিণ সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তাকে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সীমিত জনবল নিয়ে মাদকবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অধিদফতরের এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মামলা দায়ের, তদন্ত কার্যাদি সম্পাদন, গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ এবং আদালতে সাক্ষ্য প্রদানসহ অন্যান্য দাফতরিক কাজ সম্পাদনে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে হয়।’

ছয় ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা, একটিতে পরিবর্তন : ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনের ছয় শূন্য ওয়ার্ডে প্রার্থী সমর্থন দিল বিএনপি। এ ছাড়া একটি ওয়ার্ডে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। গতকাল বিকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা সিটি উত্তরের সাধারণ ২৯ নম্বর শূন্য ওয়ার্ডে (মোহাম্মদপুর) লিটন মাহমুদ বাবু, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে (তুরাগ) হারুন অর রশীদ খোকন, ঢাকা সিটি দক্ষিণে ১ নম্বর ওয়ার্ডে (খিলগাঁও) অ্যাডভোকেট ফারুকুল ইসলাম, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে (শ্যামপুর) আলীম আল বারী জুয়েল এবং ঢাকা মহানগরী দক্ষিণে সংরক্ষিত (মহিলা) কাউন্সিলর হিসেবে ২২, ২৩ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাবেয়া বাষরীন, ৭৩, ৭৪ ও ৭৫ ওয়ার্ডে মজিরনকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে (হাজারীবাগ) বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে আগে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন আবদুল আজিজ। এখন সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে বিএনপি সমর্থন দিয়েছে থানা বিএনপির নেতা হাবিবুর রহমানকে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর