শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

চলবে গাড়ি এলপি গ্যাসে

পরিবহন জ্বালানিতে আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

শিমুল মাহমুদ

পরিবহন জ্বালানিতে আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সিএনজির বদলে এলপি গ্যাসে চলবে যানবাহন। মূল্য সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে এই অটো গ্যাসে ইতিমধ্যে রাস্তায় চলছে কয়েক হাজার গাড়ি। ঢাকাসহ সারা দেশে শতাধিক অটোগ্যাস স্টেশন চালু হয়ে গেছে। রাজধানীতেই বর্তমানে অর্ধশতাধিক এলপিজি গ্যাস স্টেশন চালু রয়েছে। দেশের নেতৃস্থানীয় এলপিজি কোম্পানিগুলো এই খাতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো এলপি গ্যাসে প্লান্ট রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে।

সরকার এক সময় যানবাহনের জ্বালানিতে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস-সিএনজির ব্যবহারে উৎসাহ দিতে রেলওয়ে ও সড়ক বিভাগের জমি এই খাতের বিনিয়োগকারীদের সহজ শর্তে লিজ দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সিএনজির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সিএনজির দাম বারবার বাড়িয়ে পেট্রল কিংবা অকটেনের সঙ্গে মূল্য পার্থক্য কমানো হয়েছে। ২০০০ সালে সিএনজির ব্যবহার শুরুর সময়ে প্রতি ঘনমিটার সিএনজি সাড়ে ৭ টাকা করে বিক্রি হতো। এখন যার দর ৪০ টাকা। এবার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে ২৫ ভাগ বৃদ্ধির আবেদন করেছে জ্বালানি কোম্পানিগুলো। সেই হিসেবে সিএনজির দাম দাঁড়াবে ঘনমিটার ৪৮ টাকায়। এসব প্রেক্ষাপটে এখন সিএনজির বদলে অটোগ্যাস বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে।

বিশ্বজুড়ে গ্রিন ফুয়েল হিসেবে চিহ্নিত অটোগ্যাস উন্নত বিশ্বে যানবাহনের প্রধান জ্বালানি। এটি মূলত আমদানিনির্ভর গ্যাস। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উপজাত হিসেবে যৎসামান্য এলপিজি পাওয়া যায়। অকটেনের সঙ্গে তুলনা করলে এলপিজিতে খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম। এলপিজি সিলিন্ডার এবং কিটস সিএনজি সিলিন্ডার ও কিটসের চেয়ে সস্তা। এর সিলিন্ডারের ওজনও অনেক কম।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানান, এলপিজি তরল হওয়ার কারণে এতে সিএনজির মতো বহির্মুখী চাপ থাকে না। এটি মাত্র ৭ দশমিক ৫ প্রেশারে স্টোরেজ করা হয়। ফলে এলপিজিতে বিস্ফোরণের ঝুঁকি খুবই কম। বারবার গ্যাস নেওয়ার ঝামেলাও নেই। প্রতি বার ফিলিংয়ে ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পথ চলা যায়। এলপিজি অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হয় না। তাই ইঞ্জিনের ভিতর কার্বন না জমার কারণে বায়ু দূষণ কম হয়। প্রতি লিটার এলপিজি মাত্র ৫০ টাকা, যা এক ঘনমিটার সিএনজির থেকে অনেক বেশি মাইলেজ দেয়। সিএনজির চেয়ে এলপিজি বা অটোগ্যাস অনেক বেশি ব্যয়সাশ্রয়ী এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার এখন চাইছে বিদ্যমান সিএনজি স্টেশনগুলো অটোগ্যাসে রূপান্তরিত হোক। এতে জ্বালানি খরচ যেমন কমবে ও গাড়ি ব্যবহারকারীদেরও লাভ হবে। নিত্যদিনের রান্নায় ব্যবহৃত এলপি সিলিন্ডার গ্যাসই ইঞ্জিনের জ্বালানি হিসেবে বিশ্বব্যাপী অটোগ্যাস নামে পরিচিত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় এই অটোগ্যাস।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, এলপিজি এখন প্রাইভেট সেক্টরের হাত ধরে বিকশিত হচ্ছে। অটোগ্যাসের ব্যবসায়েও এখন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের মনোযোগ। আমাদের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোও পর্যায়ক্রমে এলপিজি গ্যাস চার্জিং সুবিধা যুক্ত হচ্ছে। ফারহান নূর বলেন, যানবাহন জ্বালানি হিসেবে সিএনজিতে ব্যবহার হচ্ছে ৪ শতাংশ গ্যাস। কিন্তু সরকার গ্যাসের মোট রাজস্বের ২২ শতাংশ পাচ্ছে এই খাত থেকে। তিনি বলেন, যেসব এলাকায় সিএনজি সুবিধা নেই সেখানে অটো গ্যাসের সুবিধা পাবে গাড়ি মালিকরা। নন গ্যাসের গাড়িগুলোও এলপিজিতে কনভার্সন করা যাবে। তবে আমদানি হয়ে বিপুলসংখ্যক হাইব্রিড গাড়ি আসছে যেগুলোকে এলপিজিতে রূপান্তরের সুযোগ কম।

বর্তমানে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস, ওরিয়ন, নাভানা, এনার্জিপ্যাক, বাংলা ট্র্যাক, ওমেরা পেট্রোলিয়াম, ক্রিস্টাল এনার্জি, বিএনবি এনার্জি, প্রজ্ঞা পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, বি এম এনার্জিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেশে এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। নিজের গাড়িতে এলপিজি ব্যবহারকারী প্রকৌশলী ইব্রাহিম হোসেন গাড়ি এলপিজি রূপান্তর করার পর আমার জ্বালানি খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে। গ্রাহকদের এলপিজির প্রতি উৎসাহিত করতে সরকারের গ্যাসটির মূল্য কমানো উচিত। ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়াও এখন বিচ্ছিন্নভাবে অটোরিকশা চলছে এলপি গ্যাসে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এলপি গ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন রুটে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। জেলা শহর থেকে দূরে অবস্থিত বিভিন্ন এলাকায় যেখানে সিএনজি স্টেশন নেই সেইসব এলাকায় সিএনজি না থাকায় এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার নিজেদের অটোরিকশায় ব্যবহার করছেন চালকরা।

সিএনজির পরিবর্তে অটোগ্যাসের ব্যবহারের প্রতি জোর দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি বিদ্যুৎচালিত গাড়ির দিকেও মনোযোগ রয়েছে। সম্প্রতি টেকসই সড়ক নিয়ে এক সেমিনারে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, প্রত্যেকটি সিএনজি স্টেশনে এখন থেকে ইলেকট্রিক চার্জিং ইউনিট বসানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমানে এলপিজি গ্যাসের সুবিধা দেশজুড়ে। অন্যদিকে গ্যাস নেটওয়ার্কের বাইরে দেশের কোথাও সিএনজি ব্যবহারের সুযোগ নেই। বর্তমানে দেশের খুলনা, বরিশাল, যশোরসহ বহু জেলায় গ্যাস পাইপলাইন নেই। ফলে সেখানে সিএনজি স্টেশনও নেই। এখন খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়াসহ আশপাশ জেলাগুলোতে এই এলপিজির ব্যবহার অনেক বেশি। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই সারা দেশে এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ চলছে। বর্তমানে নাটোর, কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফেনী, জয়পুরহাট, হবিগঞ্জ, দিনাজপুর, রংপুর, মৌলভীবাজার, বগুড়া, খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, পাবনা, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ প্রায় সারা দেশেই এলপি অটোগ্যাস স্টেশন থেকে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে। ২০০টির বেশি ওয়ার্কশপে গাড়ি এলপিজিতে রূপান্তর করা হচ্ছে। বিদ্যমান সিএনজি কনভার্সন ওয়ার্কশপগুলোতেই গাড়ি এলপিজিতে রূপান্তর করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর