শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
দি ল্লি থে কে বি শে ষ ক লা ম

ভারতের নিয়তি তৈরি শুরু করে উনিশের সেই তীব্র গর্জন

এম জে আকবর

ভারতের নিয়তি তৈরি শুরু করে উনিশের সেই তীব্র গর্জন

আধুনিক ভারতের ভিত্তি আর সংকীর্ণ ফাটল, দুটোই গড়া হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। ১৯০৯ সালে রাজনৈতিক অঙ্গনে উন্নাসিকতার বীজ ঢুকিয়ে ব্রিটিশরা চাতুরীর সঙ্গে ওই ফাটলটা ধরায়। ১০ বছর পরে মহাত্মা গান্ধী প্রাথমিক স্তরের ফাটল জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলেন নজিরবিহীন গণআন্দোলনের মাধ্যমে। সেই আন্দোলন ব্রিটিশরাজের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ভারতকে স্বাধীনতার সড়কপথে তোলে। তবে ১৯৪৭ সালে আমরা এটাও জানতে পেলাম যে, আশাবাদের চাইতে বেশি জোরে কদম ফেলে বদমেজাজ। তবু স্বীকার করতে হয় যে, ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অগ্রগতি, ঘটনার বাঁকবদল আর ক্ষুব্ধ জনমানসের উত্থান-পতন দ্বারা সৃষ্ট গর্জনের ছিল তাৎপর্যময় ভূমিকা। বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশের নিয়তি তৈরি শুরু করে দিয়েছিল উনিশের সেই তীব্র গর্জন। পশ্চাৎপটে তো অনেক ছবিই দেখা যায়। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠনের বিষয়টি নাড়াচাড়া করা যেতে পারে। এই রাজনৈতিক দলটির সূচনা করেন ইউরোপীয় আমলা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম।

কেন? ব্রিটিশ শাসন প্রক্রিয়ায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়ানোর জন্য। ১৮৫৭-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজয় স্থানীয়দের অসম্মানীয় অনুগত জীবে পরিণত করে। এ অবস্থার প্রতিকারে ভারতীয় আইনজীবী, ব্যবসায়ী আর পেশাজীবীদের একটি শ্রেণি কংগ্রেসে যোগ দেয়। কিন্তু লন্ডনে বসা কেন্দ্রীয় শাসকরা খুবই কৃপণ। তারা নেয় খুব বেশি, দেয় খুবই কম। তারা ১৮৯২ সালের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্টের অধীনে ‘দেশী’দের আইনসভার সদস্য হওয়ার সুযোগ দেয়। সেই আইনসভা পরোক্ষভাবেই নির্বাচিত। কেমব্রিজ শিক্ষিত অরবিন্দ ঘোষ (ইনি পরে ‘ঋষি’ হয়েছিলেন) তখন দেশীয় একটি রাজ্যের বিরাট পদে আসীন আমলা। অরবিন্দ বললেন, ‘ইন্ডিয়া ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ার মধ্যকার বিরোধে কোনো একটির পক্ষে মামলাকারী ছাড়া কংগ্রেস আর কিছুই নয়।’ ব্রিটিশ উদ্যোগে, আপনা আদমির মাধ্যমে ১৯০৬ সালে গঠিত হলো মুসলিম লীগ। সংগঠনটিকে পরিচিত করা হলো জনগণের তৃতীয় কণ্ঠ (থার্ড ভয়েস) হিসেবে। এরই প্রভাবে কংগ্রেসের চরমপন্থিরা রাজনীতিতে সুবিধা পেতে থাকে। অন্যদিকে, আইনসভায় ভারতীয়দের আসন সংখ্যা ১৬টি থেকে বাড়িয়ে ৬০টি করা হয়। তবে ফাটলের দিকটা বজায় থাকল। বলা হয়, ‘মুসলমানরা শুধু মুসলমান প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন।’ মানসিক বিভক্তির সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ভারত বিভক্তি। মুম্বাই নগরী (তখনকার নাম বোম্বাই) তার প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার পেল ১৮৯৫ সালে, সে বছর ২০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যারিস্টারিতে নামলেন। ৩৫ বছর বয়সে তিনি মুসলিম আসনে নির্বাচিত হলেন। ভাগ্য তাঁকে জোর সঙ্গ দেয়। তাঁর চাইতে বয়সে অনেক বড় দুজন প্রার্থীর মধ্যে ভোটাভুটির তীব্র লড়াইয়ে ফাঁক পেয়ে ওপরে উঠে গেলেন জিন্নাহ। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ নির্বাচনেও তিনি এ আসনে জয়ী হয়েছেন।

তরুণ ও জেদি আইনজীবী জিন্নাহ মাসে ১৫০০ রুপির চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, তিনি খুব শিগগিরই এ অঙ্কটির সমপরিমাণ টাকা দৈনিক রোজগার করবেন। নিজের কথা রক্ষাও করেছেন। উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তার চাইতেও বেশি জাঁকজমক জীবনযাপন করতেন জিন্নাহ। পান করতেন উন্নতমানের হুইস্কি। বাঘা বাঘা আমলাদের চেয়ে তাঁর ইংরেজি বলবার স্টাইল ছিল চমৎকার। মুম্বাইর হাই সোসাইটিতে দ্রুত ‘আকর্ষণীয়’ হয়ে উঠলেন তিনি। ‘ভারতের সমাজ সম্প্রীতি চুরমার করবে’ এই চিন্তা থেকে তিনি পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। ১৯১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আইনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে মুচলেকাবদ্ধ শ্রমের কঠোর সমালোচনা করেন। এই বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় মুচলেকাবদ্ধ হয়ে শ্রমদানের বিরুদ্ধে তাঁর বিখ্যাত আন্দোলনের সূচনা করেন। পরিহাসের বিষয়, ১৯৩০-এর দশকে এই জিন্নাহ হয়ে উঠলেন ভারত বিভাগের ঘোরতর সমর্থক। নীল চাষিদের ওপর জুলুমের প্রতিকারে ‘সরেজমিন অবস্থা’ দেখার জন্য বিহারে গিয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। দেখলেন চাষিদের করুণ দশা। যার ২০ কাঠা জমি, তার কমপক্ষে ৩ কাঠা জমিতে নীল চাষ করা বাধ্যতামূলক। এ পদ্ধতির নাম ছিল ‘তিনকাঠিয়া’। মৌসুম চলে গেলেও অন্য ফসল বুনতে দেওয়া হতো না। দৈনিক মজুরি ছিল পুরুষ ১০ পয়সা, নারী ৬ পয়সা, শিশু ৩ পয়সা। যে চাষি পরিবার দৈনিক ৪ আনা (এক টাকার এক-চতুর্থাংশ) রোজগার করতে পারত সে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করত। গান্ধী ৮ হাজার চাষির সঙ্গে কথা বলেন। কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেন। এ যাত্রায় তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় বিস্তর। পাটনার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁকে সহায়তা করেননি। তিনি ওই শহরের বিখ্যাত আইনজীবী ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ (পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি)-এর বাড়িতে গেলেন। গৃহকর্তা শহরের বাইরে ছিলেন। বাড়ির দুই চাকর চোটপাট করেছে। তারা মহাত্মাকে ভিতরবাড়ির পায়খানা ব্যবহার করতে দেয়নি। ভিতরবাড়ির কুয়ার পানিতে গোসল করতে দেয়নি। দিলে ওই চাকরদের নাকি জাত নষ্ট হয়ে যাবে। কঠিন অবস্থার সামনাসামনি হওয়াটা গান্ধীর কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল তাঁর লন্ডন জীবনের সহপাঠীর কথা। নাম মাজহারুল হক। ইনি ১৯১৫ সালে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কংগ্রেসের সম্মেলনে তাঁদের দুজনের দেখা হয়েছিল। মাজহার বলেছিলেন, ‘পাটনা এলে আমার বাড়ি এসো।’ গান্ধী খবর দিলেন। আলিশান গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন মাজহারুল হক। বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু গান্ধী বললেন, চম্পারণ যাওয়ার জন্য তাঁকে যেন ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। বিহারের উত্তরাঞ্চলের জায়গা চম্পারণ। এর কাছেই হিমালয়ের ঢাল যা নেপাল থেকে ভারতে সমভূমিতে নেমে এসেছে। বলা হয়, রামের স্ত্রী সীতার বাবা বিদ্রোহী রাজ্যের রাজা জানক এখানে রাজত্ব করতেন। কর্মযোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ছিলেন রাজা জানক। মহাত্মা গান্ধীও তাঁর কর্মযজ্ঞ শুরু করেন এখান থেকে। সেটা হলো, নিপীড়িত নীল চাষিদের দুর্দশার বিবরণ সংগ্রহ করা। ব্রিটিশ পুলিশ ও প্রশাসনের অনেক বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে গান্ধী ‘নীল চাষিদের বিবরণী’ পৌঁছে দিয়েছিলেন সরকারের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর কাছে। ফলত কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনে বাধ্য হয়। কমিটির সুপারিশে ‘তিনকাঠিয়া’ বিলোপ করে বিহার আইনসভায় ১৯১৯ সালের ৪ মার্চ পাস হলো কৃষক আইন। মহাত্মা গান্ধী তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ বইতে লিখেছেন : ‘আমার জীবনের অবিস্মরণীয় দিন চম্পারণ পৌঁছার দিন। কৃষকদের জন্য এবং আমার জন্যও রক্তিম আখরে লেখা দিন।’

সর্বশেষ খবর