রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ট্রাফিক পুলিশের সুখ-দুঃখ

মাহবুব মমতাজী

রোদ-বৃষ্টি, ধুলোবালি আর শব্দদূষণ ট্রাফিক পুলিশের নিত্যসঙ্গী। বিড়ম্বনারও শেষ নেই তাদের। দিন-রাত রাস্তায় থাকার কারণে নানা রোগে ভুগছেন তারা। এর মধ্যে সাইনোসাইটিস, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা লেগে থাকে সারা বছর। যানবাহনের তীব্র হর্নের কারণে কানের সমস্যায়ও ভোগেন অনেকে। ট্রাফিক-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেও আছে নানা প্রতিবন্ধকতা। গাড়িচালক ও পথচারীর বেশির ভাগেরই রয়েছে আইন না মানার প্রবণতা। আইন মানাতে গেলেই নানা ধরনের হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। এর পরও এসব সামাল দিয়েই দায়িত্ব পালন করেন তারা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুঃখ-কষ্টের নানা কথা।

জানা গেছে, কনস্টেবল ও সার্জেন্টদের দিনে ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের কথা বলা হলেও তারা ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন। তাদের নেই কোনো ছুটি। কাক্সিক্ষত পদোন্নতি নেই। দুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে ব্যস্ততম সড়কে কাজ করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। এর পরও তাদেরই যানজটের জন্য সাধারণ মানুষের গালমন্দ শুনতে হয়। আবার কাগজপত্রসহ নানা কারণে যানবাহন আটকালে শুরু হয়ে যায় তদবির। প্রভাবশালীরা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন কমই। অনেকে আবার চাকরি খাওয়ারও হুমকি দেন। রামপুরায় দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট জানান, ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে সার্জেন্ট হিসেবে ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেন তিনি। অদ্যাবধি একই পদে বহাল আছেন। মেধা থাকার পরও দীর্ঘদিনেও কোনো পদোন্নতি পাননি। ফলে চরম হতাশা কাজ করছে মনে। আরেক সার্জেন্ট জানান, ২০০১ সালের ব্যাচে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। একই ব্যাচের এসআই পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হয়েছেন। এখন তাকে স্যার বলতে হয়।

কথা হয় গোলাম মোস্তফা নামে এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের সঙ্গে। তিনি দায়িত্ব পালন করেন রাজধানীর শাহবাগে। এই প্রতিবেদককে জানালেন, ১৯৮৬ সালে তিনি পুলিশে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ ১৯ বছর পর ২০০৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হন। নানা জাটিলতার কারণে তাদের পদোন্নতি আটকে থাকে। ২০০৪ সালের এক রেগুলেশনের কারণে উপপরিদর্শক (এসআই) ও সার্জেন্টে পদোন্নতিতে বৈষম্য তৈরি হয়। পদ খালি থাকা সাপেক্ষে আগে এসআই যারা ছিলেন, তারা পদোন্নতি পাওয়ার পর সার্জেন্টদের দেওয়া হতো। ২০১৭ সালে ওই রেগুলেশনটা বাতিল হয়েছে। এখন প্যারালালি সবাই পদোন্নতি পাচ্ছেন। মজার বিষয় হলো, তিনি যখন চাকরিতে ঢুকেছেন, আর সেই সময় যেই ছেলের জন্ম হয়েছে, দুজনই এখন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর। ৮ ঘণ্টার কথা বলা হলেও মূলত তাদের কোনো কর্মঘণ্টা নেই। সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে ফিরতে হয় রাত সাড়ে ১০টায়। রাস্তায় দায়িত্ব পালনকালে ওয়াশরুম কিংবা বসার কোনো সুবিধা নেই। রাস্তার ধুলাবালি, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তাদের বেশির ভাগই নানা রোগে ভুগছেন। কেউ চর্মরোগে, কারও পায়ের গোড়ালির সমস্যা, পাইলসের সমস্যা, কারও কানের এবং প্রায় সবারই গ্যাস্ট্রিক সমস্যা রয়েছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মাহমুদুল হাসান জানান, রোদ-বৃষ্টি, হাঁটুপানি কিংবা বুকপানি যা-ই হোক না কেন, রাস্তায়ই থাকতে হবে। বেশির ভাগ মানুষই ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে চায় না। তাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় তদবিরে। ২০০ টাকা জরিমানা করলেই ফোন ধরিয়ে দেয়। কথা না শুনলে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি খেতে হয়। এমনকি বদলিও হতে হয়। নির্দিষ্ট এলাকার ডিউটির পরও কোথাও কোনো সরকারি প্রোগ্রাম থাকলে সেখানে ডিউটি করতে যেতে হয়। বছরের পাওনা ২০ দিন ছুটিও কাটানো যায় না। ছুটিতে গেলেও তা বাতিল হয়ে যায়। ট্রাফিকে দায়িত্ব পালনকালে নারীদের সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ কোনো ট্রাফিক বক্সে টয়লেট সুবিধা নেই। আশপাশের অফিস বা মার্কেটে গিয়ে তাদের বাথরুম সেরে আসতে হয়। রাস্তার ধুলোবালিতে শুধু পোশাকই মলিন হয় না, রোদ, গরম, গাড়ির ধোঁয়া, হর্ন ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভোগেন ট্রাফিক পুলিশরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানান, চারটি ট্রাফিক বিভাগে তাদের জনবল রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার। এর মধ্যে চারজন উপকমিশনার (ডিসি) ছাড়াও রয়েছেন চারজন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি)। রয়েছেন শতাধিক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ও সাত শতাধিক সার্জেন্ট। অন্যরা ট্রাফিক কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সর্বশেষ খবর