সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সব ভুলে গেলেন পিয়াজ ব্যবসায়ীরা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সব ভুলে গেলেন পিয়াজ ব্যবসায়ীরা

রাজধানীতে গতকাল টিসিবির পিয়াজের গাড়িতে দীর্ঘ লাইন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বছরের শুরুতেই পিয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত হয়েছিল জরুরি ভিত্তিতে আরও ২ লাখ মেট্রিক টন পিয়াজ আমদানির। পিয়াজ আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের নীতি-সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদকে সভায় এনে ব্যবসায়ীদের বোঝানো হয়েছিল, তারা যেন মাত্রাতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি না করেন। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘আপনারা অতি মুনাফা করে ভোক্তাদের কষ্ট দেবেন না।’ কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেই নৈতিকতার শিক্ষা ভুলতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় নেন। ওই বৈঠকের দুই দিনের মধ্যে শনিবার ১০০ টাকার পিয়াজ দাম বেড়ে ২০০ টাকায় ওঠে।

অস্বাভাবিক হারে পিয়াজের দাম বাড়ায় গতকাল সচিবালয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন ও টিসিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবারও জরুরি সভা করেছেন বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন। বাজারে মনিটরিং টিমও পাঠিয়েছেন তিনি। সভা শেষে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সচিব জানান, বৃষ্টির অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা হঠাৎ দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন বাজার আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সচিব জানান, বেশ কয়েকটি জেলায় তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, মুড়িকাটা পিয়াজের কোনো সংকট নেই। আগামী মাসেই হালি পিয়াজ চলে আসবে। ফলে ব্যবসায়ীরা যে অজুহাত তুলে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, এটি অযৌক্তিক। অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে সচিব বলেন, ‘বছরের শুরুতেই আমরা সভা করে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছি। কিন্তু তারা কিছুই শুনছেন না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে ফল আসেনি বলে মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে ব্যবসায়ীদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে সঠিক পথে আনতে চেয়েছিল। এ কারণে তাদের কোনো ধরনের হয়রানি না করার আশ্বাস দেওয়া হয়। এমনকি ব্যবসায়ীরা লোকসান করলে সেটিও সরকার দেখবে বলে আশ্বস্ত করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে কিছুতেই তারা নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসার বিষয়টি বুঝতে চাইছেন না। পরিস্থিতি একই রকম থাকলে সরকারিভাবে দাম বেঁধে দেওয়া হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো।

বৃহস্পতিবারের সভায় যা বলা হয়েছিল : ব্যবসায়ীদের খুশি করতে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, সিন্ডিকেট বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তার সময়ে দ্রব্যমূল্যের জন্য এক দিনও বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হয়নি। এমনকি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করে তিনি বলেছিলেন, অযথা গ্রেফতার, হয়রানি করে প্যানিক সৃষ্টি করে কোনো লাভ হয় না। ব্যবসায়ীরাও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা শুনে খুশিতে আহ্লাদিত হয়ে পণ্যের ওপর কর কমানোর দাবি তোলেন। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী সভায় বসে ব্যবসায়ীদের সামনে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন, যেন দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে কর কমানো হয়। তিনি ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, দরকার হলে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানকে ফোন করিয়ে কর কমানোর ব্যবস্থা নেবেন, যাতে করে অন্তত রোজার মাস পর্যন্ত জিনিসপত্রের দাম কম থাকে। ব্যবসায়ীদের খুশি করে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমাদের এই ২ লাখ টন আমদানি ছাড়াও যারা পিয়াজ আমদানি করেন না, তাদেরও অনুরোধ করব পিয়াজ এনে বাজার স্বাভাবিক রাখুন। এতে আপনারা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন আমরা সেটিও দেখব।’ সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর এত সব আশ্বাসেও পরিবর্তন হয়নি ব্যবসায়ীদের মানসিকতার।

ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলেছিলেন, ভারত যদি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়, তবে বেশি দামে পিয়াজ আমদানি করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা। এ কারণে ছোট আমদানিকারকরা আমদানি করছেন না। সরকার যেন ঘোষণা দেয়, ভারত রপ্তানি করলেও পণ্য নেবে না বাংলাদেশ। ব্যবসায়ীদের এ আশঙ্কা দূর করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘ভারত যদি নিষেধাজ্ঞা তুলেও নেয়, আপনার কী পরিমাণ লোকসান করছেন সেটি যাচাই করে আমরা একটি পথ বের করব, যাতে আপনাদের লোকসান না হয়।’ ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘শুধু একটিই দোহাই আপনাদের প্রতি, রাতারাতি বড়লোক হওয়া যাবে না। রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে না। প্রপার বিজনেসম্যান হিসেবে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের কাছে আপিলটা কিন্তু আমাদের এ কারণেই।’

শুধু তা-ই নয়, ভারত কর্তৃক পিয়াজের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর পণ্যটির দাম এক দিনের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় নিজে ব্যবসায়ী হিসেবে যে কষ্ট পেয়েছেন সেটিও বলতে ভোলেননি বাণিজ্যমন্ত্রী। ‘আমাকে ব্লেইম করা হয়েছে যে আপনি নিজে ব্যবসায়ী বলে (ব্যবসায়ীদের) ফেভার করছেন। আপনি আরও শক্ত হতে পারতেন, আরও কঠোর হতে পারতেন।’ আক্ষেপ করে মন্ত্রী এটিও বলেছিলেন, ‘এ জায়গায় বসে আমি আগুনের ওপর বসবাস করছি।’

বাস্তবতা হচ্ছে, সব আশ্বাস, অনুরোধ, উপরোধ আর নৈতিকতার কথা ভুলে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকে আগুনের ওপর রেখে ব্যবসায়ীরা দুই দিনের মধ্যে আবারও পিয়াজের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন। এখন দেখার বিষয়, শেষ পর্যন্ত পণ্যটির দাম বেঁধে দেয় কিনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সর্বশেষ খবর