বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

পেছনের ঘটনা জানতে কমিশন

পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

পেছনের ঘটনা জানতে কমিশন

১১ বছর আগে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে সংঘটিত হত্যাকান্ডে ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ উদঘাটনে লাভ-ক্ষতির হিসাব অনুসন্ধান করা অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেছে হাই কোর্ট। এ জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশে-বিদেশে আলোচিত এ মামলার গতকাল প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাই কোর্ট এমন মন্তব্য করে। রায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে নীতিশাস্ত্র শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিচারপতিরা। একই সঙ্গে সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীর তখনকার গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কারণ জনসম্মুখে প্রকাশের তাগিদও দেওয়া হয়েছে রায়ে। রায়ে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার যুক্তি হিসেবে হাই কোর্ট বলেছে, হত্যার বিনিময়ে মৃত্যুদন্ডের বিধান সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জরুরি। ভবিষ্যতে যে কোনো সামরিক, আধাসামরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ‘অপারেশন ডালভাত’-এর মতো কর্মসূচি পরিহারের সুপারিশ করা হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে। একই সঙ্গে সামরিক, বেসামরিক সব শ্রেণির কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সবাইকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশপ্রেমের সঙ্গে কাজ করতে প্রশিক্ষণের সুপারিশ করেছে উচ্চ আদালত। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট। এর আগে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দিন ধরে বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিল। আইন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রায় ও পর্যবেক্ষণ পৃথিবীর বিচার বিভাগের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যার ঘটনায় হাই কোর্ট তার রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড হয়েছিল ১৫২ জনের। এ ছাড়া রায়ে ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতে ১৬১ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। ২০০ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। বিচারিক আদালতে ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছিল। আর হাই কোর্টের রায়ে খালাস পান ৪৫ জন। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত বিশ্বের অন্যতম বড় এ মামলায় রায় ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় আর কোনো মামলায় এত বেশিসংখ্যক আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়নি। এদিকে গতকাল সকালে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

রায়ে বিদ্রোহের কারণ : বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী রায়ে তার পর্যবেক্ষণে নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের কারণ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, বিডিআরের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য এবং একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে বিদ্রোহ করেছে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল- ১. সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করা, ২. এই বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে সুশৃঙ্খল এই বাহিনীকে অকার্যকর করা, ৩. প্রয়োজনে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিডিআরে প্রেষণে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা, ৪. সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা, ৫. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৮ দিনের নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের প্রয়াসে অস্থিতিশীলতার মাধ্যমে দেশকে নিপতিত করা, ৬. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা, ৭. বহির্বিশে^ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং ৮. শান্তিরক্ষা মিশনে বিডিআরের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় দেশের অন্যান্য বাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা।

গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা দুঃখজনক : রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, বিদ্রোহের বিষয়টি বিডিআরের হাইকমান্ড ও বিভাগীয় গোয়েন্দাসহ সরকারের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসা সত্ত্বেও তারা কার্যকর ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যা দুঃখজনক ও চরম দায়িত্বহীনতার শামিল। বিডিআরের আরএসইউ নামে একটি নিরাপত্তা ইউনিট থাকা সত্ত্বেও তারা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রের কোনো পূর্বাভাস দেয়নি অথবা আরএসইউ স্বেচ্ছায় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিভাগীয়ভাবে ওই ব্যর্থতার ঘটনা উদঘাটনসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি অগ্রহণযোগ্য নয়।

ভয়াবহতা ছিল নজিরবিহীন : পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, হত্যাকান্ডের নৃশংসতা এতই ভয়াবহ ছিল যে, ওই ঘটনার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের বর্বরতা, পৈশাচিকতায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিডিআরের নেতৃত্বে থাকা সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তারা একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিডিআর থেকে যে কোনো মূল্যে সেনা অফিসারদের উৎখাত করে বিভাগীয় অফিসারদের দ্বারা এই বাহিনী পরিচালনা করা।

লাভ-ক্ষতির হিসাব অনুসন্ধান অপরিহার্য : ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’র বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অপরাধবিজ্ঞানে অপরাধীর অপরাধ সংঘটনে অভিপ্রায় (মোটিভ) নির্ণয়ে বিদ্যমান অন্যান্য উপাদানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অপরাধীর লাভ-ক্ষতির হিসাব অনুসন্ধান করা হয়। ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ উদঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে আইনসম্মতভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই মামলাসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মামলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।

শিক্ষার সব স্তরে নীতিশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা জরুরি : রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সমাজের সব স্তরে নৈতিকতা পুনরুদ্ধার ও শিক্ষিত জাতি গঠনে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব স্তরে নীতিশাস্ত্র বাধ্যতামূলক করা অতি জরুরি।

রায়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা : পিলখানার ওই বিদ্রোহ দমনে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করে রায়ে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে দৃঢ় মনোবল নিয়ে শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমনে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, যা ছিল দূরদর্শী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত।

১১ দফা নির্দেশনা ও ১১ দফা সুপারিশ : রায়ে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর লেখা অংশে ১১ দফা নির্দেশনা ও ১১ দফা সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বিডিআরের নিরাপত্তা বিষয়ক ইউনিট আরএসইউ বর্তমান বিজিবির মেধাবী, সৎ ও চৌকস সদস্যের সমন্বয়ে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো; বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সংস্থা আরএসইউর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা; একই সঙ্গে ওই ঘটনার পূর্বাভাস সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

রায়ে আরও বলা হয়েছে, আর্থিক লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের মধ্যে অহেতুক বিভেদ ও নৈতিক স্খলনের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্ষেত্রে ‘অপারেশন ডালভাত’ উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে অপারেশন ডালভাতের মতো অন্য কোনো আর্থিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত পরিহার করা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর