শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কাঠগড়ায় নির্বিকার মজনু

সাত দিনের রিমান্ডে, হাসপাতাল ছাড়লেন সেই ঢাবি শিক্ষার্থী, ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক

কাঠগড়ায় নির্বিকার মজনু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রী ধর্ষণ মামলার আসামি মজনুকে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম মো. সারাফুজ্জামান আনছারী রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আবু সিদ্দিক আসামিকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। এদিকে গতকালও দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করেন। অন্যদিকে চিকিৎসা শেষে গতকাল হাসপাতাল ছেড়েছেন ধর্ষণের শিকার ছাত্রী। আসামি মজনুকে গতকাল দুপুরে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কোর্ট হাজতে নিয়ে আসা হয়। পরে বেলা ৩টার একটু আগে এজলাসে হাজির করা হয়। এ সময় তার গায়ে শ্যাওলা রঙের জ্যাকেট ও নীল জিন্স প্যান্ট ছিল। পরে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই মজনু বিচারকের ডায়াসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এ সময় তিনি তার ডান পা কাঁপাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি কাঠগড়ায় বসে পড়েন। হাতকড়া পরা মজনু বসেই মুখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিচারক আসন নিলে তাকে উঠে দাঁড়াতে বলা হয়। তখন তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বিচারকের দিকে মুখ ফেরান। রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবুসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ আইন সমিতির বেশ কয়েকজন আইনজীবী সদস্য এজলাসে দাঁড়ান। এদিকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামি মজনু কোনো কথা বলেননি। তাকে বিচারকও কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। শুরুর ৫-৬ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয় শুনানি। এ সময় ধর্ষণের আসামি মজনুর পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ‘৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী রাজধানীর কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে গলফ ক্লাব-সংলগ্ন স্থানে পৌঁছান। এ সময় আসামি মজনু তাকে পেছন থেকে গলা ধরে মাটিতে ফেলে দেন। তার গলা চেপে ধরেন। ছাত্রী চিৎকার করতে গেলে মজনু তাকে কিলঘুষি মারেন। ভয়ভীতি দেখান। ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে ধর্ষণ করেন আসামি মজনু। পরে মজনুকে রাজধানী থেকে গ্রেফতার করে র?্যাব-১। মজনুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তার কাছ থেকে ভুক্তভোগী ছাত্রীর খোয়া যাওয়া সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। আসামি মজনু একজন অভ্যাসগত ধর্ষক। প্রতিবন্ধী ও ভ্রাম্যমাণ নারীদের ধর্ষণ করে আসছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় আর কেউ জড়িত কি না, তা জানতে এই আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।’ মামলা সূত্রে জানা গেছে, রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই ছাত্রী রাজধানীর কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নামেন। এরপর একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি তার মুখ চেপে ধরে সড়কের পেছনে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে ধর্ষণের পাশাপাশি তাকে নির্যাতন করা হয়। ধর্ষণের একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে রাত ১০টার দিকে সিএনজি নিয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যান। রাত ১২টার দিকে ওই ছাত্রীকে ঢামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করান তার সহপাঠীরা। এ ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন।

আধাপাগল এক ধর্ষিতা দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে মাদক সেবন করতেন মজনু : দুই মাস আগে চট্টগ্রাম কাজীর দেউড়ি এলাকার এক আধাপাগল নারীকে বেশ কিছুদিন দফায় দফায় ধর্ষণ করেন মজনু। পরে তাকে একটি লোকাল ট্রেনে করে ঢাকায় নিয়ে এসে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন এলাকায় রাখেন। ওই নারীকে দিয়ে ভিক্ষা করাতেন মজনু। ওই নারীর আয় দিয়ে তিনি ড্যান্ডি সেবন করতেন। কিছুদিন আগে ওই নারীর চুল কেটে দিয়ে তাকে বিদায় করে দেন তিনি। গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে এমন তথ্যই দিয়েছেন মজনু। মজনুর দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ওই ছাত্রীকে নির্যাতনের পর তার কাছে ৫০০ টাকা চেয়েছিলেন মজনু। তবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ওই ছাত্রী তাকে মোবাইল ফোন ও পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যেতে বলেন।

 সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত মজনু। মাদকের টাকা জোগাড় করতেই তিনি মাঝেমধ্যে ছিনতাই করেন। একই সঙ্গে রেলস্টেশন এলাকার প্রতিবন্ধী ও পাগল নারীদের ধর্ষণ করেন তিনি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ওই ছাত্রীর বাবা-মা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাদেকা হালিমের সামনে তার সঙ্গে বেশ কিছু সময় কথা বলেছি। ধর্ষকের ছবি তাকে দেখানোর পর তিনি নিশ্চিত করেছেন। একই সঙ্গে মজনুর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোন ও পাওয়ার ব্যাংকটি ওই ছাত্রীরই বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।’

হাসপাতাল ছেড়েছেন ঢাবি ছাত্রী : এদিকে গতকাল বেলা ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও বাবা-মার সঙ্গে ধর্ষণের শিকার ছাত্রী হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাছির উদ্দীন।

 

ঢাবিতে ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত : রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দিনভর এ দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তারা। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময় সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনাগুলোরও বিচার দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে রাজু ভাস্কর্যের চারদিকের রাস্তা অবরোধ করে ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দেন তারা। দুপুরে কয়েকটি দাবি-সংবলিত স্মারকলিপি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের কাছে জমা দেন শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা, জরুরি অবস্থায় মেয়েদের হলে থাকার ব্যবস্থা করা, ক্যাম্পাসে ভাসমান হকার, রিকশাওয়ালাদের রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা, পুরো ক্যাম্পাস সিসিটিভির আওতায় আনা প্রভৃতি। এর আগে অপরাজেয় বাংলা থেকে গণরুমের শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কালো পতাকা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। পরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ধর্ষকের প্রতীকী কুশপুত্তলিকা দাহ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘এটাই হোক বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শেষ প্রতিবাদ। ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকার, জনগণ সবার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ধর্ষকের শাস্তি ফাঁসির আইন প্রণয়ন করে ধর্ষণবিরোধী রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে।’

ধর্ষণের অন্য ঘটনাগুলোরও বিচার করতে হবে- ভিপি নূর : দেশব্যাপী বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত সব ধর্ষণের বিচার করার দাবি জানিয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, ‘আমাদের বোনের ধর্ষক গ্রেফতার হয়েছে। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাধুবাদ। একই সঙ্গে তাকে ধিক্কার, ধর্ষণের অন্য ঘটনাগুলোতে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।’ গতকাল বিকালে ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘সাধারণ ছাত্র পরিষদ’ আয়োজিত গণপদযাত্রায় তিনি এসব কথা বলেন। পদযাত্রাটি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও শাহবাগ প্রদক্ষিণ শেষে আবারও রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ হয়। এতে অংশ নেন সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম-আহ্বায়ক রাশেদ খান, মশিউর রহমান প্রমুখ। পদযাত্রা শুরুর আগে ভিপি নূর বলেন, ‘যখন কোনো ঘটনায় জোরালো প্রতিবাদ হয়, সেই ঘটনাগুলোর বিচার হয়। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কারণেও এসব ঘটনা ঘটছে। নির্দিষ্ট ঘটনায় প্রতিবাদ করলে হবে না। ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে একজন শিক্ষক ছাত্রলীগ নেত্রীদের মারধরের শিকার হলেন। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো প্রতিবাদ হলো না। তনুর ঘটনায় বিচার তো দূরের কথা, কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি।’ গণপদযাত্রা শেষে হাসান আল মামুন বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। তাহলেই ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর