শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু

আলোর অবয়বে ফিরলেন শেখ মুজিব কাঁদলেন হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে ৪৮ বছর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা প্রবাহের প্রতীকী মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী’র ক্ষণগণনার সূচনা হলো। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও তাদের পরিবারের সদস্য, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, দুই হাজারের বেশি আমন্ত্রিত অতিথি এবং দশ হাজারের বেশি নিবন্ধিত দর্শকের উপস্থিতিতে গতকাল বিকালে স্মরণ করা হলো সেই মুহূর্তটিকে, যেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনন্দ। ১০ জানুয়ারি বাবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই মুহূর্তের এমন প্রতীকী মঞ্চায়ন দেখে কেঁদে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তার বোন শেখ রেহানাও।

বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শিক্ষক ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, ছোট বোন শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির সদস্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং ঢাকাস্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোর রাষ্ট্রদূতরা আসন গ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী আসন গ্রহণের পর শুরু মূল অনুষ্ঠান। মাইকে জানানো হয় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তটিকে এখন প্রতীকী উপস্থাপনা দেওয়া হবে। অমনি আকাশের দিকে তাকান সবাই। ৪টা ২৪ মিনিটের দিকে রানওয়ের মাটি স্পর্শ করে যুক্তরাজ্যের রয়েল এয়ারফোর্সের উড়োজাহাজ সি ওয়ান-থার্টি জে। একই এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজে চড়ে স্বদেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন প্রখ্যাত শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান বেজে ওঠে। গানে গানে স্বাধীন শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো হয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইলেনÑ বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়/তুমি আজ ঘরে  ঘরে এত খুশি তাই/ কি ভালো তোমাকে বাসি আমরা/বলো কী করে বোঝাই...। অনেকেই গানের সঙ্গে সুর মেলান। আবিদুর রহমানের লেখা ও সুধীনদাস গুপ্তের সুর করা গান নতুন করে আপ্লুত করে।

এরই মাঝে শূন্য রানওয়ের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে উড়োজাহাজ। ৪টা ৪৪ মিনিটে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। সব দর্শকের মধ্যে তখন দারুণ উত্তেজনা। উচ্ছ্বাস। সেদিনের মতোই একদল মানুষ পতাকা হাতে উড়োজাহাজের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় গোটা এলাকা। ৪টা ৪৮ মিনিটে উড়োজাহাজের দরজার সামনে ভেসে ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ১০ জানুয়ারি বাবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই মুহূর্তের এমন প্রতীকী মঞ্চায়ন দেখে কেঁদে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তার বোন শেখ রেহানাও। লেজার রশ্মির মাধ্যমে তৈরি করা প্রতিকৃতি দৃশ্যমান হওয়া মাত্রই প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। শুরু হয় তোপধ্বনি। ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়। ঐতিহাসিক দিনটির মতোই মহান নেতাকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। এ সময় মাইকে উচ্চারিত হয়Ñ হে বীর হে নির্ভয় তোমারই হলো জয়। বঙ্গবন্ধুও যেন হাত উঁচিয়ে নিজের দেশের মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসার জবাব দেন। এর পর আলোয় মিলিয়ে যাওয়া। সেই আলো লালগালিচার ওপর দিয়ে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছায়। জাতির পিতাকে সালাম জানায় সশস্ত্রবাহিনী। বেজে ওঠে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...।

আমন্ত্রিত অতিথি ও নিবন্ধিতদের জন্য দুপুরের পর থেকেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় অনুষ্ঠানস্থলের নির্ধারিত প্রবেশ পথগুলো। সবাইকে নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বেলা ২টা থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেন।

প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার পর মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন ও ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন ল্যাপটপের বোতাম চেপে। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনে ২৮টি স্পটে, ৫৩ জেলায় ও দুটি উপজেলা মিলিয়ে মোট ৮৩টি জায়গায় বসানো কাউন্টডাউন ক্লকও সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায়। এই ক্ষণগণনা শেষে আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সূচনা হবে মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের; বছরজুড়ে চলবে সেই আয়োজন।

২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় মুজিববর্ষ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানটি হবে এ বছরের ১৭ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে, সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মগ্রহণের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। ওই অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভুটানের রাজা জিগমে খেশার ন্যামগেল ওয়াংচুক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ জায়েদ আল নাহিয়ান, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুুডো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা উপস্থিত থাকবেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও কর্মজীবন নিয়ে হলোগ্রাফিক উপস্থাপনা ও থিম সং পরিবেশিত হবে। ১৭ মার্চ মূল অনুষ্ঠানের পর থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আতশবাজি। এ ছাড়া কেনেডি পরিবারের কোনো সদস্য এবং জোসেফ স্টিগলিজ বা জেফরি স্যাকসের মতো ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

আনন্দঘন পরিবেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। এ জন্য বসানো হয়েছে ‘কাউন্টডাউন ক্লক’। এ অনুষ্ঠান ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদকদের পাঠানো তথ্য-

চট্টগ্রাম : ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা উদ্বোধন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামেও উদ্বোধন করা হয় চারটি ‘কাউন্টডাউন ক্লক’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, সংসদ সদস্য আফসারুল আমিন ও সামসুল হক চৌধুরী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম প্রমুখ। জানা যায়, জিমনেসিয়াম মাঠে বিকাল ৪টায় ভিডিও কনফারেন্স শুরুর কথা ছিল। কিন্তু দুপুর ২টা থেকেই মাঠে আসতে শুরু করেন সর্বস্তরের মানুষ। বিকাল ৩টার আগেই জিমনেসিয়াম মাঠ মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। 

রাজশাহী : জেলার ৯ উপজেলাতেও ৯টি ক্ষণগণনার যন্ত্র বসানো হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও ক্যাম্পাসে একটি যন্ত্র বসানো হয়েছে। বিকালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন।

রাজশাহীর নগর ভবনের সামনে এবং সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বড় পর্দায় সরাসরি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ দুই স্থানেই অজস্র মানুষের ঢল নামে। এ ছাড়া সাহেববাজার জিরোপয়েন্টের ক্ষণগণনা যন্ত্রের পাশে বড়পর্দার সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন শুধু দলীয় নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ।

খুলনা : খুলনা জেলা স্টেডিয়ামে ‘কাউন্টডাউন প্রথম প্রহরে মুজিববর্ষ’ ব্যতিক্রমী আয়োজন করে জেলা প্রশাসন।

এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ওপর ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান, সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, মো. আক্তারুজ্জামান বাবু, খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা।

সিলেট : ক্ষণগণনায় সিলেটের দুটি স্থানে কাউন্টডাউন মঞ্চ উদ্বোধন করা হয়েছে।

নগরীর টিলাগড় পয়েন্টে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে কাউন্টডাউন মঞ্চের উদ্বোধন করেন। এদিকে, নগরীর হুমায়ুন রশীদ চত্বরে কাউন্টডাউন মঞ্চের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। এখানে সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী, প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বরিশাল : বরিশালে ক্ষণগণনা যন্ত্র উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস, বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, রেঞ্জ ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলামসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

কলকাতা প্রতিনিধি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের ক্ষণগণনা উপলক্ষে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন গতকাল ঢাকায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে।

মিশনের ‘বাংলাদেশ গ্যালারি’তে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে বিটিভি কর্তৃক সরাসরি সম্প্রচারিত এ অনুষ্ঠানে কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ স্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন। পরে উপ-হাইকমিশনার তৌফিক হাসানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী প্রেরিত বাণী পাঠ করেন উপ-হাইকমিশনের প্রথম সচিব (প্রেস) মোফাকখারুল ইকবাল ও প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) শামীমা ইয়াসমীন স্মৃতি। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদকপ্রাপ্ত তৎকালীন আকাশবাণীর সংবাদকর্মী পঙ্কজ সাহা। শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।

সর্বশেষ খবর