বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

হয় মৃত্যু না হয় গ্রেফতার

তুরস্ক হয়ে ইউরোপ যাত্রা আর সম্ভব নয়, মর্গে পড়ে আছে লাশ, বাকিরা কারাগারে গ্রিস ইতালি স্পেনে প্রবেশে কড়াকড়ি ইউরোপীয় ইউনিয়নের

জুলকার নাইন

হয় মৃত্যু না হয় গ্রেফতার

সুনামগঞ্জে ছাতকের জামসেদ মিয়া তালুকদারের ছেলে আলাল মিয়া প্রায় একযুগ ধরে বিদেশে থাকেন। ৪৬ বছর বয়সী আলাল মিয়া জীবনের ১২ বছর কাটিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। ভালোই চলছিল সব কিছু। হাতেও বেশ কিছু টাকা জমেছিল তার। সেটা দেখেই আলাল মিয়াকে ইউরোপ যাওয়ার প্রলোভন দেখায় দালাল। কাগজপত্র ছাড়াই ইউরোপে পৌঁছানোর লোভ দেখায় দালাল। তুরস্ক থেকে গ্রিস নিয়ে যাওয়ার কথা জানানো হয়। একপর্যায়ে ওমান ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে আলাল। দালালের হাতে তুলে দেয় মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু তুরস্ক থেকে স্পিডবোটে দুর্গম মহাসাগর পার হয়ে গ্রিসে পৌঁছানো যে এখন অসম্ভব তা জানতে দেওয়া হয়নি আলালকে। টাকার লোভে আলালকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় দালাল। অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই গত ২৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে স্পিডবোট ডুবে সাগরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আলাল মিয়া।

গ্রিস যাওয়ার কথা বলে রওনা হওয়া স্পিডবোটটি তুরস্কের পূর্বদিকে লেক ভ্যান হ্রদে ডুবে যায়। এই লেক দিয়েই মরণযাত্রার রুট ঠিক করে দালালরা। ছোট স্পিডবোটে আলালের সঙ্গে ছিল আরও ৭১ জন। এর মধ্যে ১৫ জন বাংলাদেশি, বাকিরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের। ইরান সীমান্তের কাছাকাছি লেক ভ্যানে দুর্ঘটনাস্থলে কাছাকাছি থাকা জেলেদের মাধ্যমে খবর পায় তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা। সৌভাগ্যক্রমে স্পিডবোট ডুবে যাওয়ার তাৎক্ষণিক তৎপরতায় জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয় ৬৪ জনকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় পাঁচজনের। আরও দুজন হাসপাতালে মারা যায়।

আলালের মতোই ঘটনাস্থলেই মারা যায় সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের পাইগাঁও গ্রামের মুজিবুর রহমানের ছেলে মিজানুর রহমান। ৩২ বছর বয়সী মিজানুর রহমানের এক ভাই ইতালি, আরেক ভাই গ্রিসে থাকেন। গ্রিসে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে ২১ ডিসেম্বর রওনা দেয় মিজানুর। তুরস্ক গিয়ে ২৫ ডিসেম্বর উঠে সেই স্পিডবোটে। আলাল ও মিজানের মতো করুণ মৃত্যু হয় সিলেট জেলার বালাগঞ্জের পূর্ব মুসলিমাবাদ গ্রামের সৈয়দ আহমেদের ছেলে সৈয়দ ফয়সাল আহমেদ এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুরির শালগাঁও গ্রামের চৌধুরী ওসমান ইউসুফের ছেলে চৌধুরী ইউসহা ওসমানির। তুরস্কের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তুরস্ক হয়ে ইউরোপ যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। তুরস্ক-ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ফলে এ পথে অবৈধ অভিবাসন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য যে কোনোভাবেই দালাল চক্রের কথায় প্রভাবিত হয়ে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ইত্যাদি দেশ হয়ে তুরস্কে অনুপ্রবেশ করা মানেই জীবনের ঝুঁকি নেওয়া ও মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। লেক ভ্যানের মর্মান্তির ঘটনাই এর প্রমাণ। দূতাবাস জানায়, স্পিডবোট দুর্ঘটনার পর যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আটক করে রেখেছে তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনানুসারে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তুরস্ক। শাস্তি শেষে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। আটক থাকা বাংলাদেশিরা হলেন- যশোরের ঝিকরগাছার রাইপতন গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে ইসমাইল হোসেন, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের আবদুল হকের ছেলে আমির হামজা, শরীয়তপুরের রাজৈরের চর মোস্তফাপুর গ্রামের গিয়াস উদ্দিন বয়াতির ছেলে হাসান বয়াতি, সুনামগঞ্জ জগন্নাথপুরের শালদীঘা গ্রামের দেলোয়ার হোসাইনের ছেলে অলি আহাদ, সিলেটের বিশ্বনাথের হিসবপুর গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে আক্কাস মিয়া, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কাদিরপুর গ্রামের নিয়ামত আলির ছেলে শাওন আহমেদ, কুমিল্লার মুরাদনগরের রাজাছাপিতলা গ্রামের চন্দন দেবনাথের ছেলে সৈকত দেবনাথ, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের সিদ্ধাশপুর গ্রামের আবদুল মোমিন খানের ছেলে মনজিল খান, কুমিল্লার দাউদকান্দির দনেশ্বর গ্রামের হাজী আয়াত আলীর ছেলে মো. আলম, শরীয়তপুরের পালংয়ের মধ্য সোনামুখী গ্রামের মো. খলিলুর রহমান মোল্লার ছেলে কামাল মোল্লা, মাদারীপুর সদরের উত্তর দুদখালী গ্রামের মো. হাবিবুর রহমান খানের ছেলে আশিক খান। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, শুধু নৌপথে নয় তুরস্ক হয়ে সড়ক পথেও গ্রিসে প্রবেশের কোনো উপায় এখন আর নেই। সীমান্তে কঠোর নজরদারিতে চোখ এড়ানোর কোনো উপায় নেই দালালচক্রের। গত ১০ জানুয়ারি প্রতিবেশী তুরস্ক থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে গ্রিসে প্রবেশের চেষ্টা করে ১০ বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের একটি দল। পুলিশের তাড়া খেয়ে মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয় তারা প্রত্যেকেই। সেদিন মধ্যরাতে গ্রিসে কাভালা জেলার কাছে প্রধান সড়কে একটি চেকপয়েন্টে তাদেরকে থামতে বলা হয়। কিন্তু তারা গাড়ি না থামিয়ে চলতে থাকে। ফলে পুলিশ তাদের পিছু নেয়। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে থেসালোনিকি শহরে এর শেষ হয়। এ সময়ে তাদেরকে বহনকারী গাড়ি লাল বাতির সিগন্যাল অমান্য করে আঘাত করে আরেকটি যাত্রীবাহী গাড়িতে। এতে অভিবাসীরা আহত হয়। তার মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশি। দুজন সিরিয়ার নাগরিক। আর অন্য গাড়ির একজন চালক। সিরিয়ার নাগরিকদের ও গাড়ি চালককে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছাড়পত্র দিলে গ্রিসে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়। ১০ বাংলাদেশি মারাত্মক আহত হওয়ায় এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা শেষ হলেই এই বাংলাদেশিদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাবে গ্রিসের পুলিশ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর