বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বিদ্রোহীদের নিয়ে হার্ডলাইনে দুই দল

ঠাঁই হবে না কোনো কমিটিতে তবুও পিছু হটছে না কেউ

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

বিদ্রোহীদের নিয়ে হার্ডলাইনে দুই দল

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে হার্ডলাইনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই দলই। এমনকি কমিটিতে জায়গা না দেওয়ারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দুই দফায় প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে বিদ্রোহীদের বসে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে তাদের বসে যাওয়ার কঠোর বার্তা দিয়ে চিঠি দেওয়া হবে। কেউ না বসলে তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে মদদদাতাদের বিরুদ্ধেও। এরই মধ্যে বিএনপি বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে। বিদ্রোহীরা সরে না গেলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তও রয়েছে দলটির। তবে দুই দলের বিদ্রোহীদের প্রায় সবাই অনড়। কঠোর বার্তা সত্ত্বেও কোনো প্রার্থীই পিছু হটছেন না।

আওয়ামী লীগ : কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে হার্ডলাইনে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এতদিন কৌশল করে বিদ্রোহীদের ডেকে কথা বলে আগামীতে মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে পদায়নসহ সব ধরনের মূল্যায়নের আশ্বাস দিলেও কর্ণপাত করেননি প্রার্থীরা। যে কারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে দলটি। গতকালও দক্ষিণ সিটির ঢাকা-৫ আসনের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুল সবুর, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হারুনুর রশিদ। এ আসনের এমপিকে অভিযুক্ত করা হলেও অসুস্থতার কারণে তিনি বৈঠকে ছিলেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন, বিদ্রোহী ও তাদের মদদদাতাকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা আরও দু-এক দিন সময় নেব-তারপর চূড়ান্ত বহিষ্কার করা হবে।

সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যে নির্বাচন করবে তাকে বহিষ্কার করা হবে। আগামীতে তাদের মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি কিংবা সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবি দেওয়া হবে না। দল করতে হলে অবশ্যই শৃঙ্খলা মানতে হবে।’

এদিকে আওয়ামী লীগের হার্ডলাইনে যাওয়ার ঘোষণায় অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী নমনীয় হতে শুরু করেছেন। তারা চাইছেন, আওয়ামী লীগ ব্যক্তির নামে চিঠি ইস্যু করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করলে তারা মাঠে থাকবেন না। আবার কোনো কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী গোপনে বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের ও ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাইছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মামুনুর রশিদ শুভ্র। গতকাল তিনি বলেছেন, দল যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেয় সেটা তো মেনে নিতেই হবে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য লিখিত নির্দেশনা দেয় তাহলে আমি নির্বাচনী কার্যক্রম গুটিয়ে  নেব। তিনি বলেন, নির্বাচনে মাঠে থাকতে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফির সঙ্গে কথা হয়েছে, এই জন্য আমি মাঠে আছি।  

ঢাকা দক্ষিণে ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন আবদুর রহমান মিয়াজী। এ ওয়ার্ডে তাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রার্থী হয়েছেন কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহাবুদ্দিন জনি। তার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর সার্জেন্ট ফরহাদ হত্যা মামলা রয়েছে। দক্ষিণের ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক। তাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রার্থী হয়েছেন খোরশেদ আলম বাবু মাস্টার ও আওলাদ হোসেন। তারা দুজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। এদিকে অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা তাদের মদদ দিচ্ছেন। দক্ষিণে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন আবুল কালাম অনু। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ফজলুল হক। তিনি বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আতিকুল্লাকে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম অনু অভিযোগ করেন, বিদ্রোহী প্রার্থী বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নৌকার বিরোধিতা করছেন। অন্যদিকে নাশকতা মামলার আসামিকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ দিচ্ছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীরা আমার দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাঁধে ভর করে ধানের শীষের ভোট জোগাড় করছেন। এতে আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন, বিদ্রোহীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে তাদের বহিষ্কার করা হবে। এমনকি আগামীতে মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও তাদের কোথাও রাখা হবে না।’

বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বহিষ্কৃত কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের তারিকুল ইসলাম, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বিল্লাল শাহ, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ময়নুল হক ওরফে মঞ্জু, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের দেলোয়ার হোসেন খান, উত্তর সিটিতে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জহিরুল ইসলাম, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ। ঢাকা উত্তর সিটির ২০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথম দলের সমর্থন পেয়েছিলেন জাহিদুর রহমান। এলাকাবাসীর দাবির মুখে প্রার্থী পরিবর্তন করে এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. নাছিরকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনী মাঠ ছাড়েননি জাহিদুর রহমান। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন আবদুল্লাহ আল মঞ্জুর। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মীর আশরাফ উদ্দিন খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোকছেদ আলী মোল্লা। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর শামীম হাসান। বিদ্রোহী হিসেবে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানা। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা। বিদ্রোহী প্রার্থী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাইজুল ইসলাম চৌধুরী।

বিদ্রোহীদের চিঠি দিল বিএনপি : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির কাউন্সিল পদে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে এতদিন মৌখিক অনুরোধ করলেও এবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করল বিএনপি। দুই সিটিতে প্রায় ৩০ বিদ্রোহী প্রার্থীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ওইসব প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতেও অনুরোধ করা হয়েছে। নির্দেশনা না মানলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

উত্তর সিটি নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং সদস্য সচিব মো. শাহজাহান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনি নির্বাচনে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করায় দল মনোনীত মেয়র প্রার্থীর বিজয়ে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।’ দলের বিজয় ও ঐক্য অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে দল মনোনীত মেয়র ও সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজে অংশ নিয়ে সহযোগিতা কামনা করা হয় চিঠিতে। সূত্রমতে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে ৩ নম্বর ওয়ার্ডে জামাল হাসান বাপ্পী, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বুলবুল মল্লিক, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে হাবিবুর রহমান ও মোহাম্মদ রিপন, ৭ নম্বরে গোলাম রাব্বানী, ৮ নম্বরে সোলাইমান খান দেওয়ান, ১৬ নম্বরে সৈয়দ ইকরাম হোসেন, ১৮ নম্বরে কাজী আবদুল লতিফ, ২০ নম্বরে সেলিম আহমেদ রাজু, ২৩ নম্বরে আবুল মেসের, ২৫ নম্বরে হাসেম মিয়া ও শেখ জিয়াউর রহমান, ৩০ নম্বরে আবুল হাসেম, ৩১ নম্বরে হাসিনা মোর্শেদ কাকলী ও ফরিদউদ্দিন ফরহাদ, ৩৭ নম্বরে আহমদ আলী এবং ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে হেলাল তালুকদার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। দক্ষিণ সিটির ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। এর মধ্যে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে আনোয়ার হোসেন লিপু, ১৩ নম্বরে নজরুল ইসলাম জুয়েল, ১৫ নম্বরে আবু নাছের লিটন, ৩৭ নম্বরে সুমন ভূঁইয়া, ৩৯ নম্বরে মোজাম্মেল হক মুক্তা, ৪৬ নম্বরে মো. সোহেল ও ঢালী মামুনুর রশীদ, ৫০ নম্বরে আনোয়ার হোসেন স্বাধীন, ৫১ নম্বরে কবির আহম্মেদ, ৫২ নম্বরে বাদল রানা, ৫৫ নম্বরে শহিদুল হক, ৫৯ নম্বরে খোরশেদ আলম খোকন, ৬১ নম্বরে শাহ আলম এবং ৬৬ নম্বরে নুরুদ্দিন মিয়া বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। জানা যায়, প্রতিপক্ষের বাধা এবং প্রশাসনিক চাপের পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে চরম অস্বস্তিতে বিএনপি। প্রতিকূল অবস্থা উত্তরণে বিদ্রোহীদের বসিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে দুই সিটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে দক্ষিণের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতা আবদুস সালাম বলেন, দক্ষিণের বিদ্রোহীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বিদ্রোহীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে দল সমর্থিতদের পক্ষে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। নইলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান জানান, দলের আদেশ মেনে বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত থাকবে না। সবাই দলের আদেশ মেনে নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর