বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

তাপসের ইশতেহারে পাঁচ রূপরেখা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা- এমন পাঁচটি রূপরেখা দিয়ে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেছেন, ডিএসসিসি হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে গতকাল দুপুরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঘোষিত ইশতেহারে পাঁচ রূপরেখা ছাড়া ইশতেহারের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে দক্ষিণ সিটিতে গত ১১ বছরের উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিবরণ। ইশতেহারের এই পাঁচ রূপরেখায়- ঢাকার ঐতিহ্য ধরে রাখা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশনকে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা করা, ওয়ান স্টপ সার্ভিস ডেস্ক স্থাপন, সব সেবা অনলাইনভিত্তিক করা, হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়ানো, মশক নিধন, সবুজায়ন, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা বৃদ্ধি, বায়ু ও শব্দদূষণ রোধ, যানজট নিরসন, মাদক নির্মূল ও জুয়া বন্ধ, পরিবার পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যকর, সংশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করাসহ আরও বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেন তাপস। পাশাপাশি ইশতেহারে দক্ষিণ সিটিতে গত ১১ বছরের উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিবরণও উল্লেখ করেছেন তিনি।

নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মোজাফফর হোসেন পল্টু, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল, আফজাল হোসেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কেন্দ্রীয় সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দিলীপ রায়, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা অপু উকিল, যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহি প্রমুখ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ও নগর আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পাঁচ রূপরেখায় তার প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস।

ঐতিহ্যের ঢাকা : নির্বাচিত হলে ঐতিহ্যের ঢাকা ফিরিয়ে আনার কথা জানিয়ে তাপস বলেন, ৪০০ বছরের পুরনো আমাদের এই ঢাকার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাসের উজ্জ্বল ছবি, ঐতিহ্যের গভীর শেকড় ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব।

আমি নির্বাচিত হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে ‘ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’ হিসেবে গড়ে তুলব। সবাইকে নিয়ে সমন্বিত প্রয়াসে জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি নির্মাণ এবং প্রদর্শনীসহ নগরীর ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণে মহাপরিকল্পনা ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে বিশ্ব দরবারে ঢাকাকে তার স্বকীয় গৌরবে সাজিয়ে তুলে ধরব।

সুন্দর ঢাকা : সুন্দর ঢাকা গড়ে তোলার কথা জানিয়ে তাপস বলেন, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা দুই নদীর অববাহিকায় পত্তন হওয়া আমাদের এই ঢাকা। এমন শহর পৃথিবীতে বিরল! সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্যান নির্মাণ, সবুজায়ন, ছাদবাগানে উৎসাহ, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা বৃদ্ধি, বায়ু ও শব্দদূষণ রোধসহ শরীর ও চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, শরীর চর্চা কেন্দ্র এবং নারী-শিশু ও প্রবীণদের জন্যে হাঁটার উন্মুক্ত স্থান, আধুনিক মানের কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থা, সর্বসাধারণের সুবিধার্থে সাধারণ ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ব্যবস্থা, দুস্থ-অসহায়দের কল্যাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বস্তি উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনীর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘিরে বনায়ন, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যাপক সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলব।

সচল ঢাকা : যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তাপস বলেন, যানজটের কারণে রাস্তায় চলাচল হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। গণপরিবহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু রাস্তায় দ্রুত গতির যানবাহন, কিছু রাস্তায় ধীর গতির যানবাহন, আবার কিছু রাস্তায় শুধু মানুষ হাঁটার ব্যবস্থা করব। নদীর পাড়ে থাকবে সুপ্রশস্ত রাস্তা, যেখানে পায়ে হেঁটে চলা যাবে, চালানো যাবে সাইকেল, চলবে রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি। দ্রুতগামী যানবাহনের জন্য থাকবে আলাদা পথ, থাকবে নিরাপদ সড়কব্যবস্থা। রাস্তা পারাপারের সুব্যবস্থাসহ নগর ঘুরে দেখার জন্য থাকবে ‘হপ অন হপ অফ’ বাস সেবা। থাকবে প্রয়োজনীয় সড়কবাতি ও উন্নত প্রক্ষালণ কক্ষ। হকারদের তথ্যভান্ডার গঠন করে তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ফুটপাথ দখলমুক্ত করা হবে। এভাবে গড়ে তুলব আমাদের সচল ঢাকা।

সুশাসিত ঢাকা : মাদক নির্মূল, জুয়া, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধসহ এলাকাভিত্তিক সুশাসিত ঢাকা গড়ে তোলার কথা জানিয়েছেন তাপস। তিনি বলেন, ঢাকায় একসময় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। মাদক নির্মূল, জুয়া, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধসহ এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কার্যকর ও সংশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করব। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা। বছরের ৩৬৫ দিন, সপ্তাহের ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য খোলা থাকবে। মশকের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, মশক নিধনে দৈনন্দিন ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল-ডিসপেনসারি ও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনসহ মাতৃসদন, পরিবার পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক কারিগরি-ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কোনো ধরনের হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর) বৃদ্ধি করা হবে না জানিয়ে তাপস বলেন, গৃহকর বৃদ্ধি হবে না। হতদরিদ্র সন্তান-সন্ততির শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষা, বিনোদন ও চিকিৎসাসেবায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে ফায়ার হাইড্রান্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা গবে।

উন্নত ঢাকা : উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই মেয়র প্রার্থী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশের ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে উন্নত রাজধানী তথা উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের জনগণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণসহ প্রতিটি সড়ক ও নর্দমার উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মান নিরূপণ করে অন্তত ১০ বছর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বিবেচনায় নিয়ে জমির যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুব্যবস্থাসহ ছাত্র ও কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক হোস্টেল গড়ে তোলা হবে। নাগরিকদের জন্য ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন সেবা থাকবে জানিয়ে তাপস বলেন, ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন এবং নাগরিক সেবা ও সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ নগর অ্যাপ চালু করা হবে।

শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সবার সমর্থনে চেষ্টা করেছি এক এক করে প্রতিটি সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় সংসদ সদস্য হিসেবে নাগরিকদের মৌলিক সুবিধা ও উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। তাই এই ঢাকাবাসীর জন্য বৃহৎ পরিসরে কাজ করার এবং তাদের মৌলিক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার তাগিদ বোধ করেছি। লিখিত ইশতেহার পাঠ শেষে তাপস সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এ সময় তিনি বলেন, কোনো কর না বাড়িয়ে দুই বছরের মধ্যে ডিএসসিসি স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। সংস্থার টাকায় সব ব্যয় বহনের পাশাপাশি নেওয়া হবে উন্নয়ন প্রকল্প। সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে নগরে ডিএসসিসির অভিভাবকত্ব নিশ্চিত করা হবে বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর