রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

নজিরবিহীন কম ভোটারের নির্বাচন

নিজস্ব প্রতিবেদন

গতকাল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্রগুলোয় ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এমন কম ভোটারের নির্বাচনের নজির অতীতে দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। অর্থাৎ কম ভোটার উপস্থিতির ক্ষেত্রে এ নির্বাচন ছিল নজিরবিহীন। সিইসি কে এম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশের কম। তবে রাতে দেখা যায় উত্তরে ২৪.৩৬ ও দক্ষিণে ২৯.০২ শতাংশ ভোট পড়েছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোট পড়েছিল ৩৭ আর দক্ষিণে ৪৮ শতাংশ। ভোটার কম থাকলেও দিনভর সব কেন্দ্রের সামনেই নৌকা প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের জটলা দেখা গেছে। একই কর্মী-সমর্থক দিনভর পালাক্রমে লাইনে দাঁড়িয়ে কেন্দ্র উৎসবমুখর রাখার চেষ্টা করেছেন। ভোটারবিহীন কেন্দ্রের বুথে বুথে নৌকা সমর্থকদের ব্যস্ত দেখা গেছে। অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। গতকাল দিনভর দুই সিটির কেন্দ্রগুলো ঘুরে ভোট পর্যবেক্ষণ করেছেন আমাদের রিপোর্টাররা। তাদের পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রে ভোটার খরার পাশাপাশি নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। সকাল সাড়ে ৯টায় উত্তর সিটির মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রগুলোয় ভোটার উপস্থিতি ছিল না। তবে মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের গলায় নৌকা প্রতীক ঝুলিয়ে ভোট দিতে দেখা গেছে। মোহাম্মদপুরের আরেক কেন্দ্র রাবেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায় কেন্দ্রের প্রবেশ গেটের সামনে নৌকার কয়েক শ কর্মী খোশগল্পে মেতে রয়েছেন। ভিতরে নিরিবিলি পরিবেশে ভোট গ্রহণ চলছে। এখানেও ধানের শীষের কাউকে পাওয়া যায়নি।

মিরপুর-১০ নম্বরের আদর্শনগর উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১১টায় দেখা যায় পোলিং এজেন্টরা ভোটারদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। কয়েকজন ভোটার এলে তাদের নিয়ে বুথে বুথে প্রবেশ করেন নৌকা প্রতীকের কর্মীরা। এই কেন্দ্র পরিদর্শন করেন মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। পরে তিনি কর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এদিকে ওই কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে কমিউনিস্ট পার্টির মেয়র প্রার্থী ডা. আহমেদ সাজেদুল হক রুবেল অভিযোগ করেন, তার একজন কর্মীকে সকালে অপহরণ করা হয়েছে। ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ভোট দিতে আসেনি। মিরপুরের মণিপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের কোনো কোনো বুথে ভোটারদের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে দেখা গেছে। আবার কোনো বুথ ছিল শূন্য। আঙ্গুলের ছাপ না মেলায় ভোট প্রদানে এদিক-ওদিক দৌড়াতে দেখা গেছে অনেককে। এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শংকর কুমার বলেন, ‘দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ ভোট কাস্টিং হয়েছে।’ পাশেই মণিপুর গার্লস হাইস্কুল শাখা কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। সেখানে ভোটারের চেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ছিলেন বেশি। তবে বিএনপি প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিলেন না। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চারটি কেন্দ্রে ১০ হাজারের অধিক ভোটার। অনেক বুথে ভোটারের অপেক্ষায় যেন প্রহর গুনেছেন পোলিং এজেন্টরা। দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে ১০ শতাংশের কম ভোট পড়ে। মিরপুরের অধিকাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট দেখা যায়নি। বেলা ২টায় একই চিত্র দেখা যায় উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবির ব্যাপক তৎপরতা ছিল। কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের কয়েক শ কর্মীর সরব উপস্থিতি ছিল। বিএনপির কাউকে দেখা যায়নি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট কেন্দ্র আইইএস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এ কেন্দ্রেই ভোট দেন। ভোট শুরুর প্রথম আধঘণ্টায় এ কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। বিএনপির কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি এই কেন্দ্রে। এক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার জানান, এজেন্টরা একটু বাইরে গেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো ভোটার আসেননি। কেউ ভোট দেননি। এদিকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দুপুরে সপরিবার মগবাজার ইস্পাহানি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেন। কেন্দ্রের ৩ নম্বর কক্ষে ভোটার ৪৫১ জন। তবে চার ঘণ্টায় বুথে ভোট পড়েছে মাত্র ৪৬টি।

এদিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মিরপুরের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়েছে। তবে কেন্দ্রগুলোয় সকাল থেকে ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। শেওড়াপাড়ার দুটি কেন্দ্রে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। শেওড়াপাড়ার হলি ক্রিসেন্ট স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে দেখা যায় ভোটারদের শরীর তল্লাশি করে কেন্দ্রে ঢোকানো হচ্ছে। এ নিয়ে ভোটারের সঙ্গে পুলিশ ও আনসারদের তর্কবিতর্ক হতে দেখা গেছে। মধুবাগ নয়াটোলা এইউএন কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে বেলা ১১টায় গিয়ে দেখা গেছে বাইরে ভোটারের লাইন। তবে কেন্দ্রের সামনে অবস্থানরত নৌকার ব্যাজ পরিহিত কিছু তরুণ পরিচিত ভোটার ছাড়া অন্যদের ভিতরে ঢুকতে দেননি। বিকাল ৩টায় শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে দেখা যায় ভোটার উপস্থিতি খুব কম। ১০৯ নম্বর কক্ষে মাত্র ৩৬ জন ভোট দিয়েছেন। এ বুথেও দেখা গেল নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ভোটারদের সঙ্গে নিয়ে বুথে ঢুকছেন। এ ব্যাপারে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার সিনথিয়া বলেন, ‘যারা ইভিএমে ভোট দিতে পারছেন না তাদের কেউ সহায়তা করছেন।’ দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, ধোলাইপাড়ের কয়েকটি কেন্দ্রে দেখা গেছে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। বেলা ১টার দিকে এসব কেন্দ্রে ২০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন বলে রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানান। এসব কেন্দ্রের কোথাও ভোটারের লাইন দেখা যায়নি। দনিয়ার একে স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে বেলা ১১টায় অধিকাংশ বুথ ফাঁকা দেখা গেছে। কিছু কিছু বুথে ভোটারদের ভোট দিতে দেখা গেছে। ধোলাইপাড় উচ্চবিদ্যালয়ে ১২টার দিকে দেখা গেছে কেন্দ্রের সামনের সড়কে ব্যাপক লোকজনের উপস্থিতি। এ সময় দুই প্রার্থীর উত্তেজিত সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। খিলগাঁও, রামপুরা, শাহজাহানপুর, মতিঝিলের কোনো কেন্দ্রেই ভোটারের উপস্থিতি খুব একটা চোখে পড়েনি। বেশির ভাগই কেন্দ্রেই ভোটারের লাইন ছিল না। কেন্দ্রের বাইরে নৌকার সমর্থকের ভিড় দেখা গেলেও ছিল না ভোটার। খিলগাঁও মডেল কলেজ, খিলগাঁও মডেল স্কুল, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। মতিঝিল এজিবি কলোনির ভিতরে স্থাপিত একাধিক কেন্দ্র ঘুরেও একই দৃশ্য চোখে পড়েছে। রামপুরা একরামুন্নেছা স্কুলে স্থাপিত কেন্দ্রে অবশ্য মহিলা ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বেশির ভাগ ভোটারের অভিযোগ ছিল তারা ভোট দিতে পারেননি। অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি।

রাজধানীর আদাবর থানার পিসি কালচার হাইস্কুল কেন্দ্রে সাড়ে ৮টায় হঠাৎ করে ১ নম্বর পুরুষ বুথের ইভিএম মেশিনটি নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট অপারেটর বললেন, সেটি হেন্গড হয়ে গেছে। ফলে এই বুথের ভোট স্থগিত করে দিয়ে নতুন আরেকটি ইভিএম আনা হয়। সকাল পৌনে ৯টায় পুরনো মেশিনটি পরিবর্তন করে আবারও নতুন মেশিনে ভোট নেওয়া শুরু হয়। এ বুথে ৩৮২ ভোটারের মধ্যে তখন পর্যন্ত ভোট পড়ে মাত্র তিনটি। পিসি কালচার হাই স্কুল কেন্দ্রের কোনো বুথেই তখন বিএনপি প্রার্থীর কোনো পোলিং এজেন্ট দেখা যায়নি। তবে যুব ও ছাত্রলীগের ২০-২৫ জনের একটি দলকে কেন্দ্রটির সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে মোহাম্মদপুর রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ (ডিআরএমসি) ও ধানমন্ডি সিটি কলেজের বাইরে সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশ বজায় থাকলেও ভিতরে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সকালের দিকে এ দুই কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে সেগুনবাগিচা হাই স্কুল কেন্দ্রে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের একদল যুবক। এ সময় তাদের প্রত্যেকের গলায় ঝুলছিল সরকারি দলের প্রার্থীর ছবি ও প্রতীক (নৌকা)-সংবলিত কার্ড। এ সময় তারা কেন্দ্রে উপস্থিত আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা সাধারণ ভোটার কাউকেই মানেনি। নারীপুরুষনির্বিশেষে গণহারে লাঠিপেটা করে সবাইকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। হামলাকারীদের বক্তব্য ছিল, ‘সব বের হয়ে যা। কোনো ভোটের দরকার নাই।’ তাড়া খেয়ে ভোটাররা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এসে জড়ো হন এবং সেখানে ঘণ্টাদেড়েক বিক্ষোভ করেন।

ফল প্রত্যাখ্যান ইসলামী আন্দোলনের : ভোটারদের ভোট দিতে না দেওয়া, এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়া, ভোটদানে বাধা, ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল কারচুপি এবং আগের রাতে এজেন্ট না দিতে হুমকিসহ নানা অভিযোগ এনে দুই সিটির নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর চরমোনাই। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি জালিয়াতি, প্রহসন ও ডিজিটাল কারচুপির ফলাফল বাতিল করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান।

তিনি সরকারের আজ্ঞাবহ ও ব্যর্থ ইসির পদত্যাগ দাবি করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চরমভাবে উদ্বিগ্ন। নির্বাচন নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের আর কোনো আগ্রহ অবশিষ্ট নেই।’ তিনি বলেন, নির্বাচনের নামে এ ধরনের প্রহসনের কোনো মানে হয় না। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা দিয়ে দিলে জনগণের অর্থ ব্যয় হতো না। তিনি জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ২৮ কেন্দ্র থেকে তাদের ৩ শতাধিক এজেন্টকে মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর