সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বাজারে ডিজেল সংকট

কৃষি সেচ ও পরিবহন খাতে অচলাবস্থার আশঙ্কা

মানিক মুনতাসির

সারা দেশে সেচ মৌসুম আংশিক শুরু হয়েছে। পুরোদমে শুরু হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগবে। তার আগেই ডিজেলের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল সরবরাহ করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কৃষকরা চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল না পেলে সেচকাজ বাধাগ্রস্ত হবে। যার প্রভাবে পড়বে উৎপাদনে। শুধু তাই নয়, সংকট প্রকট হওয়ার আগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে শিল্প এবং পরিবহন খাতেও সৃষ্টি হতে পারে অচলাবস্থা। কারণ, দূরপাল্লার বেশির ভাগ বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, ছোট-মাঝারি শিল্প-কারখানার ব্যবহৃত জেনারেটর ও কাভার্ড ভ্যানগুলো ডিজেলচালিত। সেই সঙ্গে শিল্প ও আবাসন খাতে দৈনিক বিপুল পরিমাণ ডিজেলের চাহিদা রয়েছে জেনারেটর চালাতে। তবে বিপিসি বলছে, ডিজেলের কোনো সংকট নেই। বিপিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ দিনে চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। যা কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক। এ জন্য নিয়ন্ত্রিত সরবরাহ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। আর পেট্রলপাম্প মালিক সমিতি বলছে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই। আমদানি পর্যায়ের সরবরাহ চেইনে কোথাও একটা সমস্যা থাকতে পারে। যা সরকার হয়তো পাবলিকলি শেয়ার করছে না। এর ফলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করছে না। এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান, মো. সামছুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হঠাৎ করেই চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তবে সরবরাহে কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। আমদানি পর্যায়েও কোথাও কোনো জটিলতা নেই। কয়েকটি জাহাজ বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে কোথাও কোথাও গুজব রয়েছে যে, ডিজেলের সংকট রয়েছে। এ জন্য আমরা সরবরাহের ক্ষেত্রে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছি। কেননা ২০০৯ সালে প্রান্তিক পর্যায়ে দাম বেড়ে যাবে বা সংকট তৈরি হবে এমন গুজবে মানুষ পলিথিনে করে ডিজেল মজুদ করেছিল। আমরা এ জন্য বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরবরাহ নীতিতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছি। আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পাশাপাশি হঠাৎ চাহিদা বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ জন্য গুজবই দায়ী। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ও শ্যালো মেশিন মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতেই ডিজেলের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে দাম এখনো স্বাভাবিক রয়েছে। ভরা মৌসুমে ডিজেলের সংকট হলে সেচকাজ চরমভাবে ব্যাহত হতে পারে। এ জন্য তারা এক ধরনের আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদরের বেগুনবাড়ী গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম। এ জন্য সংকট প্রকট হওয়ার আগেই সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তিনি। বিপিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ দিনে সারা দেশে ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। ১৫ দিন আগে দৈনিক ১৪ হাজার ৪০০ টন ডিজেল বিক্রি হলেও জানুয়ারি শেষ সপ্তাহে এমনকি গতকালও ডিজেল বিক্রি হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টন। চাহিদা ছিল আরও বেশি। এর আগের বছরের একই সময়ে দৈনিক বিক্রি হতো ১৩ থেকে ১৪ হাজার টন। সে হিসাবে প্রতি বছর দেশে প্রায় ৫৫ লাখ টন ডিজেলের চাহিদা রয়েছে। যার পুরোটাই আমদানি করতে হবে। এর সিংহভাগই কুয়েত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, কুয়েত পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে প্রিমিয়ামের দর কষাকষি না মেলায় চুক্তি নবায়ন করতে কয়েক সপ্তাহ দেরি হয়েছে। যার ফলে ওই সময়ে চারটি জাহাজ বন্দরে ভিড়ার কথা থাকলেও ভেড়েনি। এতে অন্তত এক লাখ ২০ হাজার টন থেকে দেড় লাখ টন জ্বালানি তেল কম আমদানি হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে। যার সিংহভাগই ছিল ডিজেল। অন্যদিকে সংকট মোকাবিলার জন্য ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে পার্বতীপুর ডিপোতে রেল ওয়াগনের মাধ্যমে ২০২০ সালের জন্য ৬০ হাজার টন ডিজেল আমদানির জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যয় হবে ৩১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে ডিজেলের সরবরাহ নিয়ে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পেট্রলপাম্প মালিকরা অভিযোগ করছেন, গত ১০-১৫ দিন থেকে তাদের চাহিদা অনুসারে ডিজেল সরবরাহ করা হচ্ছে না। তবে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসি বলছে, দেশে ডিজেলের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া ডিজেল নিয়ে একাধিক জাহাজ সমুদ্রে অবস্থান করছে। তাই সংকটের আশঙ্কা নেই। এখন বিপিসির ডিপোগুলোতে প্রায় দেড় লাখ টন ডিজেল মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে অন্তত ৮ থেকে ১০ দিন চলবে। পাইপলাইনে আছে কয়েকটি জাহাজ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হক বলেন, প্রায় ১৫ দিন ধরে চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল সরবরাহ করছে না বিপিসি। এর ফলে আমরাও গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছি না। তবে বিপিসি বলেছে, কয়েকটি জাহাজ বন্দরে তেল খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। সরকার আন্তরিক হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এদিকে মোটর মালিক সমিতি ও শিল্প উদ্যোক্তারাও ডিজেলের সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বছর সেচ মৌসুমে সেচ কাজের জন্যই অন্তত ১৮ লাখ টন চাহিদা রয়েছে। পাশাপাশি জেনারেটর, বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ অন্যান্য খাতের জন্যও প্রতিদিন প্রায় ১৫-১৮ হাজার টন ডিজেলের চাহিদা রয়েছে। জানা যায়, প্রতি বছরের ডিসেম্বর-এপ্রিল পর্যন্ত এ পাঁচ মাস দেশে কৃষিসেচ মৌসুম হিসেবে স্বীকৃত। তবে উত্তরবঙ্গে খরা দীর্ঘায়িত হলে সেচ মৌসুম সম্প্রসারিত হয়। দেশে মোট বিক্রয়কৃত ডিজেলের প্রায় ২৩ শতাংশ কৃষি খাতে ব্যবহৃত হয়। সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে কৃষিতে সেচকার্যেও সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে দেশের সর্বত্র বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে কৃষিসেচ মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিপিসিই একমাত্র ভরসা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর