শিরোনাম
সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মাতৃভাষা ছেলেখেলার জিনিস নয়

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

মাতৃভাষা ছেলেখেলার জিনিস নয়

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আমরা যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে আগুনে পড়লাম। ব্রিটিশ উপনিবেশ পার হয়ে এলাম পাকিস্তান উপনিবেশে। পরাধীনতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারলাম না। সেই উপনিবেশের বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম শুরু। ভাষা আন্দোলন দিয়েই সেই সংগ্রামের সূত্রপাত। আন্দোলনটা শুধু ভাষার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, এটা ছিল জাতি হিসেবে আমাদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রাপ্তির আন্দোলন। সেখান থেকে পেলাম নিজের ভাষা, তারই ধারাবাহিকতা ১৯৭১ সালে পেলাম স্বাধীন দেশ। ভাষা আন্দোলনটা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। আন্দোলনটা এখনো চলমান এবং চালিয়ে যেতে হবে। ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া ভাষাটির মর্যাদা রক্ষা ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম চালিয়ে  যেতে হবে। প্রশ্ন আসতে পারে- ‘এই মুহূর্তে ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা কী?’ আমরা তো একটা বৈশ্বিক অবস্থানে চলে গেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, আমাদের মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। ফলে ইংরেজিসহ আরও কয়েকটি ভাষা যেমন আমাদের প্রয়োজন। পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। না হলে আমাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বা জাতি স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাঙালিরা যেখানেই থাকবে তাদের একটা আত্মসচেতনতা থাকতে হবে, তারা যে একটা স্বাধীন জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই বিবেচনাটা থাকতে হবে। আর তার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে নিজেদের ভাষা। সে জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্যতম অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা যা পেয়ে যাই তার যত্ন নিতে পারি না। বাংলা ভাষার মর্যাদা তখনই আমাদের কাছে বেশি ছিল যখন এটি বিপন্ন ছিল। পাকিস্তান উপনিবেশ আমলে বাংলাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছে। আরবি হরফে বাংলা লিখতে বলা হয়েছে। এই বিপন্নবোধের সময় আমরা ভাষা নিয়ে অনেক সক্রিয় ছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমরা ভুলে গেলাম একটা ভাষার মর্যাদা রাখার জন্য জেগে থাকতে হয়। বাংলাকে আমরা মাতৃভাষার সত্যিকার বাহন করতে পারলাম না। আজও বাংলাকে আমরা সব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এ ছাড়া ভাষাকে সত্যিকার অর্থে ব্যবহার করতে না পারলে সেটি বিপন্নই থেকে যাবে। এখন বাংলায় কথা বলার সময় আমরা অকারণে অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। শব্দ আমরা অন্য ভাষা থেকে নেব। আগেও নিয়েছি। মডেম, ইন্টারনেট আমাদের শব্দ না। এগুলো নেব। কিন্তু ‘লাইক করুন’, ‘সেন্ড করুন’, এটা কী ধরনের বাংলা? বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্র আমরা নিজেরাই সীমিত করে ফেললে তো ভাষার মর্যাদা রক্ষিত হবে না। এফএম রেডিওগুলো ভাষাকে নিয়ে ছেলেখেলা করছে। মাতৃভাষা তো ছেলেখেলার জিনিস নয়। ভাষার বহু রকম প্রকাশ আছে। কিন্তু এমন বিকৃত প্রকাশ তো থাকার কথা নয়। আমাদের আঞ্চলিক প্রকাশ যথেষ্ট সমৃদ্ধ। কোথায় কী ভাষা ব্যবহার করতে হবে সেটা তো আমাকে জানতে হবে। বাংলা আমরা নানাভাবে ব্যবহার করব। কিন্তু এর একটা সুন্দর রূপও আমাদেরকে ধরে রাখতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছা উচিত। ভাষার মর্যাদা নিয়ে স্লোগান দেওয়ার দরকার নেই, প্রতিদিনের ব্যবহারে নিজ নিজ জায়গা থেকে মর্যাদার প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন।

ভাষা এক স্থানে স্থির থাকবে তা নয়। ভাষার বিবর্তন হয়। যেমন চর্যাপদ থেকে বিবর্তন ঘটেছে। বিবর্তনের পাশাপাশি সমৃদ্ধিও ঘটেছে। আমাদের আঞ্চলিক ভাষা যেমন প্রমিত ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি একটি আঞ্চলিক ভাষা আরেকটিকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই আঞ্চলিক ভাষাগুলো নিজস্ব মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। চর্যাপদের পর থেকেও আমরা দেখেছি স্থানীয়ভাবে আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা বাহন হয়েছে। মুঘলরা ফার্সি ভাষা চাপিয়ে দিল, ইংরেজরা এসে ইংরেজি চাপিয়ে দিল, তখনো বাংলা ভাষার ক্ষতি হয়নি, উল্টো সমৃদ্ধ হয়েছে। আমরা আরবি, ফার্সি, ইংরেজি সব ভাষা থেকে নিয়েছি। এই প্রবাহমানতাই ভাষার শক্তি। বাংলা ভাষার শক্তি কম থাকলে প্রবাহমানতায় ঘাটতি থাকত। হাজার বছর ধরে মাঠে-ঘাটে মানুষ বলে আসছে বিধায় ভাষাটি এত শক্তিশালী। এ ছাড়া ভাষায় প্রতিদিনের জীবন-যাপনের চিত্র প্রতিফলিত হয়। চর্যাপদ থেকে নিয়ে আমাদের যত সাহিত্য রচিত হয়েছে- সবখানেই আমাদের জীবনকে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। ভাষা জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল না হলে একটি প্রকোষ্ঠে বন্দী হয়ে যায়। যে দুর্ভাগ্যটা ঘটেছে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। ল্যাটিন ভাষার ক্ষেত্রে। এগুলো জীবনের ভাষা ছিল না। ছিল প্রতিষ্ঠানের ভাষা। প্রতিষ্ঠানের ভাষা বেশি দিন টেকে না। বাংলা ভাষা কখনো প্রতিষ্ঠানের ভাষা ছিল না। সেখানে এলিট সমাজের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এজন্য এই ভাষাটি অনেক শক্তিশালী ভাষা। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ভাষাটির সমৃদ্ধি ঘটেছে। তার সঙ্গে অবদান রেখেছে শিক্ষিত শ্রেণি। সব মিলে ভাষার স্রোতটা সব সময় বেগবান থেকেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক। অনুলেখক : শামীম আহমেদ

সর্বশেষ খবর