মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ফলাফলে দুই দলই সতর্ক

ধারাবাহিক সাফল্য হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ, পরাজয়কেও অর্জন মনে করছে বিএনপি

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

ফলাফলে দুই দলই সতর্ক

সদ্যসমাপ্ত দুই সিটি ভোটের ফলাফলে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে স্বস্তি ও সতর্ক মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ বিজয়কে ধারাবাহিক সাফল্যের অংশ হিসেবে দেখছে। বিজয়ে দলটির আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। তবু ভোট কম হওয়ায় আওয়ামী লীগের ভিতরে আলোচনার ঝড় বইছে। এ থেকে উত্তরণের উপায়ও খোঁজা হচ্ছে। অন্যদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ পরাজয়েও অখুশি নয়। এর মধ্যেও অনেক কিছুই অর্জন আছে মনে করছে দলটি। তার পরও দলের নীতিনির্ধারকরা এ ভোটে নিজেদের ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা করছেন। বিশেষ করে কেন্দ্রে এজেন্ট রাখতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, নগরবাসী উন্নয়নের পক্ষে। তারা উন্নয়ন চায়, উন্নত রাজধানী চায়। বিগত ১১ বছর টানা ক্ষমতায় থেকে বর্তমান সরকার সারা দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন করেছে। নিজ এলাকায় উন্নয়ন দেখে সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও দলীয় প্রার্থীরা সেই উন্নয়ন ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। তাদের দেওয়া জনবান্ধব প্রতিশ্রুতি- ঢাকা ঘিরে ৩০ বছর মেয়াদি দীর্ঘ পরিকল্পনা, ৯০ দিনের মধ্যেই মৌলিক সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, সুন্দর-সচল ও সুশাসিত-উন্নত ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি, ওয়ার্ড ধরে ধরে দুই মেয়রের পরিকল্পনাই ভোটারদের মুগ্ধ করেছে। কিন্তু বিএনপি এটাকে জাতীয় রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে চেয়েছিল, যা ঢাকাবাসী ভালোভাবে নেয়নি। ফলে তারা উন্নয়নকেই বেছে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রার্থী এবং উন্নয়নের প্রতিই ভোটারদের আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে।

অন্যদিকে প্রথমবারের মতো এত বড় পরিসরে ইভিএমে ভোট গ্রহণ, বিএনপির মাঠে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ‘কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের’ ঘোষণা, কাউন্সিলর পদে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী এবং নির্বাচনের আগে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কূটনীতিকের ‘অতিতৎপরতা’ চিন্তায় ফেলেছিল ক্ষমতাসীনদের। মুবিজবর্ষের সূচনালগ্নে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের আগে সংঘাতের আশঙ্কাও ভাবিয়ে তুলেছিল দলটিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘বিচ্ছিন্ন’ কয়েকটি ঘটনা ছাড়া কোনো সংঘাত ও সংঘর্ষ ঘটেনি। ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকায় সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবেই নিচ্ছে। এতে স্বস্তিও ফিরেছে নীতিনির্ধারণী মহলে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় নেতা-কর্মীসসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘আত্মবিশ্বাস’ বহুগুণে বেড়ে গেছে। তাই নগরবাসী আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই মেয়র প্রার্থীর পক্ষেই রায় দিয়েছেন। ঢাকার মানুষ উন্নয়ন আর সুখ-সমৃদ্ধ জীবন চায়। কেউ উন্নত জীবন ছেড়ে কখনই অনুন্নত বা অনিরাপদ পথে হাঁটতে চাইবে না। মানুষ আলো ছেড়ে কখনই অন্ধকারের দিকে পা মাড়াবে না।

আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, নৌকা হলো উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতীক। ফলে ঢাকার উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন জনগণ তাকেই ভোট দিয়েছেন। আর বিএনপির নেতিবাচক রাজনীতি তাদের জনগণ ও নেতা-কর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

এদিকে সদ্যসমাপ্ত দুই সিটি ভোটে পরাজয়েও অর্জন দেখছে বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বতর্মান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, তা আবারও জাতির সামনে প্রমাণ করতে পেরেছে বিএনপি। তা ছাড়া ইভিএম নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সেটাই তরুণ প্রজন্মসহ সবার সামনে প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে ভোটের প্রচারে ঢাকার ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা রাজপথে নেমে এসেছেন। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তাও সিটি নির্বাচনের সুবাদে অনেকটাই দূর হয়েছে। নেতা-কর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। ঢাকা মহানগরীতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। ইভিএমে ভোট জালিয়াতির ইস্যু নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি আন্দোলনও জোরদার করা যাবে বলেও মনে করেন নেতারা।

বিএনপিসূত্র জানান, সরকারও নির্বাচন কমিশনের সমালোচনার পাশাপাশি নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। এজেন্টসহ নেতা-কর্মীদের যে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তা কেন পালন করা সম্ভব হয়নি, এ নিয়েও আলোচনা চলছে। নেতা-কর্মীদের কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোটের দিন কাউকেই কেন্দ্রের আশপাশেও দেখা যায়নি। কেউ চেষ্টাও করে দেখেনি। বিশেষ করে প্রতিটি কেন্দ্রে কেন এজেন্ট গেল না, তা নিয়েও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এজেন্টদের যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তাদের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন লন্ডনে অবস্থান নেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে আমাদের অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে দুুটো অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো এই ভোটের সুবাদে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সব ভেদাভেদ দূর হয়েছে। সবাই এখন ঐক্যবদ্ধ। দুই সিটিতে আমরা দুজন তরুণ নেতাকেও পেয়েছি। আরেকটি হলো আমরা ভোটাধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা সিটি নির্বাচনে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ইভিএম নিয়ে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। সে আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।’

জানা যায়, রাজধানীতে তৃণমূলে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোতেও দুর্বলতাও ছিল। ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে ঢাকা মহানগরী বিএনপির অধিকাংশ এলাকায় নেই কমিটি। কোনো কোনো স্থানে কমিটি থাকলেও তা ছিল কারও পকেটে। সে ক্ষেত্রে দুর্বল সংগঠন দিয়ে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মোকাবিলা করাও দলটির জন্য কঠিন ছিল। তবে অর্জন বা ও দুর্বলতা যা-ই থাকুক তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আন্দোলন জোরদারেরও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভোট যা-ই হোক বিএনপি আর বর্জনের রাজনীতিতে যাবে না। কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, ভোট বর্জন কোনো সমাধান নয়। বরং ভোটে সরকার কারচুপি করলে তা গণমাধ্যমের সুবাদে দেশ-বিদেশকে জানানো যায়। এটাকে ইস্যু হিসেবে নিয়ে পরবর্তীতে আন্দোলনও গড়ে তোলা সহজ হয়। তাই স্থানীয় সরকারসহ সামনের সব নির্বাচনেও যেতে পারে বিএনপি। বিশেষ করে সামনে চট্টগ্রাম সিটি ভোট ও ঢাকা-১০ ধানমন্ডি আসনের উপনির্বাচনে যাওয়ার পক্ষেও দলের একটি অংশ। তবে ভিন্নমতও পোষণ করেন বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো ভোটে না যাওয়ার পক্ষেই তাদের অবস্থান। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইভিএমের কারচুপির নগ্নরূপ জাতি দেখতে পেয়েছে। সরকার ও অথর্ব নির্বাচন কমিশনের প্রতি এ দেশের তরুণ সমাজ অনাস্থা জানিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীরাও ভোট কেন্দ্রে যাননি। আমি মনে করি, এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপির আর কোনো ভোটে যাওয়া উচিত হবে না। বিএনপি মনে করে, সিটি ভোটের পরাজয়ের পরও রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ তাদের তাদের পক্ষে। বিশেষ করে তরুণ দুই প্রার্থীর পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মূল্যায়ন করা হলে ভবিষ্যতে আরও তরুণ রাজনীতিতে সক্রিয় হবে। এ দুজনকে নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও ভাবছেন। পাশাপাশি তৃণমূল নেতৃত্বের ধাপে ধাপে কিছু দুর্বল দিকও বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে এখন দলের সাংগঠনিক শক্তিকে সত্যিকারার্থে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ পাবে। তবে নেতা-কর্মীরা মনে করেন, এবার শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

এদিকে আগামীকাল সকালে নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানাতে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন ঢাকা উত্তর সিটির বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণ সিটির মেয়র প্রার্থী প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন। তাবিথের মিডিয়া সমন্বয়কারী মাহমুদ হাসান জানান, তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনের নির্বাচন-পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলন বুধবার বেলা ১১টায়। গুলশানের ইমানুয়েল ব্যাংকুয়েট হলে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। জানা যায়, দুই সিটি ভোটে নানা অনিয়মের তথ্যচিত্র তুলে ধরবেন বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর