শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
কারাগারে খালেদা জিয়ার দুই বছর

মুক্তির পথ খুঁজছে বিএনপি

দায়সারা কর্মসূচি, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা, তৃণমূলে হতাশা ক্ষোভ

মাহমুদ আজহার

মুক্তির পথ খুঁজছে বিএনপি

দুই বছর ধরে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া দলের প্রধান বেগম জিয়ার এখন আর মুক্তির আশাও দেখছে না বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা খুবই কম। রাজপথে কঠোর আন্দোলন বা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই তাঁর মুক্তি হতে পারে। তা নিয়েও দলের ভিতরে চলছে নানা আলোচনা। যে কোনো প্রক্রিয়ায় তারা বেগম জিয়ার মুক্তির পথ খুঁজছেন। বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ৭৪-ঊর্ধ্ব কারাবন্দী বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। তাঁর মুক্তি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে বিশেষ আবেদনও করতে চান তারা। তবে বেগম জিয়ার এখনো সম্মতি মেলেনি।

এদিকে বেগম জিয়ার মুক্তিতে বিএনপি শুরু থেকে এ পর্যন্ত দায়সারা গোছের কিছু কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এতে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও ক্ষুব্ধ। তারা চান দলীয় প্রধানের জন্য রাজপথের কঠোর কর্মসূচি। কিন্তু সিনিয়র নেতারা বলছেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগকে রাজপথে মোকাবিলা করে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। তবে সিনিয়র নেতারা বেগম জিয়াকে কারামুক্ত না করার পেছনে নিজেদের ব্যর্থতাকেও কিছুটা দায়ী করেন।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার রায় ঘোষণার পর বিএনপি-প্রধান খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেডিকেল বোর্ডের অধীনে চিকিৎসাধীন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে, বেআইনিভাবে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। তিনি এখন খুবই অসুস্থ। বিচারব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা সাজিয়ে এখন তাঁকে তাঁর সাংবিধানিক প্রাপ্য জামিন পাওয়ার অধিকারও দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বারবার আদালতে গিয়েছি। কিন্তু আদালতের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ থাকায় সুফল পাচ্ছি না। তবে আমরা গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি। বেগম জিয়া ও গণতন্ত্রের মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই।’

খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বেগম জিয়া বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণেই জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাঁর জামিন মিলছে না। আমরা শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে থাকব। পাশাপাশি রাজপথও উত্তপ্ত করতে হবে। তবে সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া তাঁর কারামুক্তি সম্ভব নয়।’

জানা যায়, সম্প্রতি পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার্থে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার বিষয়টি নিয়ে নিজেরা বসেছিলেন। পরিবারের সবাই রাজিও হয়েছেন। এ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গেও তারা আলোচনা করবেন। সর্বশেষ তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে কথা বলবেন। তিনি রাজি হলেই আবেদন করা হবে। তবে এর আগেই একবার প্যারোলে মুক্তির বিষয় দল ও পরিবারের দিক থেকে পৃথকভাবে বেগম জিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। তিনি উভয় পক্ষকেই ক্ষোভের সঙ্গে তা ‘নাকচ’ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। জামিন আমার সাংবিধানিক অধিকার।’ এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন নতুন করে দলের ভিতরে-বাইরে ও পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

পরিবারের সদস্য ও দলের একটা অংশ মনে করে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সর্বশেষ জামিন আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ শুনানি করে খারিজ করে দেওয়ায় আইনি পথে তাঁর মুক্তির পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যায়। এরপরই গত ২৪ জানুয়ারি বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন তাঁর সেজ বোন সেলিমা ইসলামসহ স্বজনরা। বোনের মুক্তির বিষয়ে নতুন করে আবেদন করার কথা জানিয়ে সেলিমা ইসলাম অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা এখনো আবেদন করিনি। ভাবছি আবেদন করব। তবে এখনো ঠিক করিনি। কারণ খালেদা জিয়ার শরীরের যে অবস্থা, তা এভাবে চলতে থাকলে জীবিত অবস্থায় আমরা তাঁকে বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’

বিএনপি নেতারা বলছেন, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যেদিন খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়, তখন তাঁর জন্য নেতা-কর্মীদের যে আবেগ ছিল, এখন আর তা নেই। এ কারণে আন্দোলনের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করাও কঠিন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগেও যদি সরকারের সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করা হতো তাহলেও মুক্তির একটা সম্ভাবনা ছিল। ওই নির্বাচন দেশি-বিদেশি সব মহল অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারকে চাপে রেখেছিল। এর পরও সুযোগ এসেছিল। নির্বাচিত এমপিরা শপথ নেওয়ার আগে যদি সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করতেন সেখানেও খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হতো। দলের নীতিনির্ধারকরা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হাতে থাকা কোনো অস্ত্রই কাজে লাগাতে পারেননি। পুরো বিষয়টিই ছিল রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এ অবস্থায় সরকারের সঙ্গে সংলাপ-সমঝোতা ছাড়া তাঁর মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই বলেও মনে করছেন তারা।

নিঃসঙ্গ ফিরোজা : খালেদা জিয়ার ভাড়া করা বাসভবনের নাম ‘ফিরোজা’। গুলশান এভিনিউর ৭৯ নম্বর সড়কের প্রথম বাড়ি। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতেও নেতা-কর্মীতে সরগরম ছিল বাসার সামনের সড়ক। গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, একেবারেই নির্জন, নিঃশব্দ একটি বাড়ি। প্রধান ফটক বন্ধ। চার নিরাপত্তাকর্মী পালাক্রমে পাহারা দেন এই শূন্য বাড়িটি। বাসায় গত দুই বছর ধরে কেউই থাকেন না। বাসার সামনে ছোট একটা সবুজ অঙ্গন, সেটাও ঠিক আগের মতো রয়েছে। সবুজ অঙ্গনে গাছের ৫-৬টি শুকনো পাতা পড়ে আছে। দোতলা বাসার সবকটি দরজা-জানালা বন্ধ।

একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, ‘এখন এ বাসায় কেউই থাকেন না। বলতে গেলে একেবারেই শূন্য। জানুয়ারির শেষ দিকে ম্যাডামের ছোট ছেলে মরহুম কোকো স্যারের স্ত্রী সিঁথি আপাসহ (শর্মিলা রহমান সিঁথি) তার দুই মেয়ে এসেছিলেন বিদেশ থেকে। ৫ ফেব্রুয়ারি তারা চলে গেছেন বিদেশে।’ ওই নিরাপত্তাকর্মী আরও জানান, এ বাসভবনের গ্যাস ও টেলিফোন লাইন বন্ধ বহুদিন ধরে।

মামলার অবস্থা : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মোট ৩৭টি মামলার মধ্যে ৩৫টিতেই জামিনে রয়েছেন তিনি। এখন তাঁর কারামুক্তির জন্য দন্ডপ্রাপ্ত দুটি মামলায় জামিনের প্রয়োজন। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন গত ১২ ডিসেম্বর খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। এ কারণে এখন এ মামলায় সাত বছরের দন্ডের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যে আপিল বিচারাধীন রয়েছে, তা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া আপিল বিভাগের কাছে জামিন আবেদন খারিজের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা চেয়েও আবেদনের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তাঁর আইনজীবীরা। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা বৃদ্ধি করে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার করা আপিল বিচারাধীন রয়েছে। ওই আপিলের সঙ্গে তাঁর একটি জামিনের আবেদনও রয়েছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই খালেদা জিয়াকে আসামি করে মামলা দায়ের করে দুদক। অপরাধজনিত বিশ্বাসভঙ্গ, দন্ডবিধি ৪০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি করা হয়। অন্যদিকে ২০১১ সালের আগস্টে দুদক ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাটি দায়ের করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর