শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে

অসীম সাহা

বাংলা ভাষা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে

শুধু সাহিত্যে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও আমরা আমাদের ভাষাকে ঠিকমতো ধরে রাখতে পারিনি। সাধারণ মানুষ তো আর প্রমিত ভাষায় কথা বলবে না। লেখ্যরূপে যে ভাষাটা প্রয়োগ করা দরকার সেক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে দেখছি ভুল। সংবাদপত্রগুলো হলো সংযোগমূলক একটা মুখপত্র। তারা পর্যন্ত ক্রমাগত বানান ভুল করে যাচ্ছে। আমরা যদি রাস্তাঘাটে দেখি, সাইনবোর্ড দেখি- সর্বত্র ভুল। ধরে নিলাম সাধারণ মানুষ ভাষা অতটা বোঝে না। কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণি যেসব ভুল করছেন সেগুলোও ভয়াবহ। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যেও ভুলের ছড়াছড়ি। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকদের লেখার মধ্যে এত ধরনের বানান ভুল এবং বাক্যগত অসঙ্গতি থাকে, যেটা বহন করা সত্যিই কঠিন। আমি কবিতা লিখি। পাশাপাশি ৩৫ বছর ধরে ভাষা নিয়ে কাজ করছি। সম্প্রতি বাংলা ভাষায় সবচেয়ে সহজ অভিধান লিখেছি। আমি সেখানেও দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, অকারণে ভাষাকে ভারাক্রান্ত করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভাষাটিকে দূরে ঠেলে দেওয়ার অপপ্রয়াস তথাকথিত পন্ডিতরা করে যাচ্ছেন। সাহিত্যে উন্নতি ঘটাতে প্রথমত ভাষাটিকে সঠিকভাবে জানতে হবে। আমি কোন শব্দটি ব্যবহার করলে এটা সংযোগমূলক ভাষা হবে তা বুঝতে হবে। আমি তো এমন ভাষা তৈরি করতে পারি না যেটা পাঠক বুঝতেই পারল না। তাতে আমি হয়তো ভাষার বাহাদুরি করতে পারব, কিন্তু পাঠকের মন জয় করতে পারব না। সেজন্য একজন লেখককে অবশ্যই শুদ্ধ ও সহজ ভাষায় লেখার চর্চা করতে হবে। শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা বাড়াতে আমাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে যারা শিক্ষা দেন, বিশেষত যারা বাংলা শিক্ষা দেন, তাদের যথাযথ বাংলা ভাষায় শিক্ষিত করে তোলা দরকার। কিন্তু এটা হয় না। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার। তা না হলে রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। লেখ্যরূপে ভাষাটিকে যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখতে না পারলে শুধু মৌখিকভাবে ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারব না। দুঃখের বিষয়, এই ভুল দূর করার জন্য যে উদ্যোগ অনেক আগেই আমাদের নেওয়া দরকার ছিল, সেটা আজও আমরা পারিনি। তা না হলে যে দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সেই দেশে কেন হাই কোর্টকে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য নির্দেশ দিতে হয়? এর চেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার তো কিছু হতে পারে না। আমরা কি ঔপনিবেশিক শাসনে বাস করছি? আমরা তো দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। তিনি বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার স্বপ্ন কি আমরা পূরণ করতে পারছি? এর দায় কার? দায় অবশ্যই সুশীল সমাজের, আমাদের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের। আমাদের কবি, লেখক, সাহিত্যিক যারা আছেন, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন, তাদের দায়িত্ব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। এখন তরুণ যারা লিখছেন তাদের অনেকেই ভালো লিখছেন। কিন্তু সেভাবে তাদের লেখাটা পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে বলে মনে হয় না। আমাদের মিডিয়াগুলোতে এখন সাহিত্যের অনুষ্ঠান হয় না বললেই চলে। কারণ সাহিত্যের অনুষ্ঠানের জন্য স্পন্সর পাওয়া যায় না। অথচ ব্যান্ড সংগীত বা পাশ্চাত্যের কিছু আনলে তার জন্য স্পন্সরের অভাব হয় না। এ কারণে টেলিভিশনগুলো স্বাভাবিকভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারপরও জাতীয় দায়িত্ব মনে করে টেলিভিশনগুলোর সাহিত্যের অনুষ্ঠান করা উচিত। সেক্ষেত্রে তরুণদের বেশি বেশি সুযোগ দিতে হবে। বেসরকারি চ্যানেল অত বেশি করতে না পারলেও সরকারি চ্যানেল তো করতে পারে। যদিও তারা করেন, তবে আরও বেশি অনুষ্ঠান করা দরকার, আরও বেশি তরুণদের সুযোগ দেওয়া দরকার। তাহলে আমরা বুঝতে পারব নতুন প্রজন্মের কারা ভালো করে লিখতে পারছেন। আর সাহিত্য চর্চায় পঠন, পাঠন এবং সাধনের কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো লেখকের আত্মপ্রশিক্ষিত হওয়াটা খুবই জরুরি। লেখক : কবি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর