মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না ঋণখেলাপিরা

একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার আধিপত্য কমানোর সুপারিশ

মানিক মুনতাসির

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে লজ্জা দিতে তাদের নাম দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। পাশাপাশি পত্রিকায়ও এদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তারা কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। এ তালিকা প্রকাশের এক মাসের মধ্যে বন্ধক রাখা সম্পত্তি দখল ও বিক্রির জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ঋণ খেলাপিরা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আর কোনো ঋণ পাবেন না। এরা যাতে বিলাসবহুল বিদেশ ভ্রমণ না করতে পারেন সেজন্য তাদের তালিকা পাঠানো হবে বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে এদের ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ি ও বাড়ি  রেজিস্ট্রেশন এবং ব্যবসা নিবন্ধনে। শুধু তাই নয়, যেসব পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং জেনারেল ম্যানেজার  খেলাপিদের সুবিধা দেবে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ ধরনের কঠোর বিধান রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধন করছে সরকার। খসড়া আইনে, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের যাতে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয় সেজন্য রাখা হয়েছে বিশেষ বিধান।

এ ছাড়া ব্যাংক পরিচালকদের নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার পথ বন্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে তাদের ঋণ নেওয়ার বিষয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঋণখেলাপি কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। এমনকি পরিচালক থাকা অবস্থায় কেউ ঋণখেলাপি ঘোষিত হলে তিনি আর স্বপদে থাকতে পারবেন না। কোনো ব্যাংকে একক ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ধারণের একক আধিপত্য কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর সংশোধনী ধারায়। একইভাবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় পরিচালক, শীর্ষ ব্যবস্থাপনাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুপারিশও করা হয়েছে আইনের সংশোধনীতে। এ ছাড়া অস্তিত্বহীন নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে-বেনামে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কড়া বিধিনিষেধ আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে আইনের সংশোধনীতে। ব্যাংক  কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর সংশোধনী চূড়ান্ত খসড়ায় সর্বসাধারণের মতামতের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে উন্মুক্ত করা হয়েছে গতকাল। আইনের সংশোধনীতে বলা হয়, ব্যাংক-কোম্পানির  চেয়ারম্যান, পরিচালক, ম্যানেজার, বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের পর তার পূর্বতন কর্মক্ষেত্রের গুরুতর অপরাধের বিষয়টি তদন্তে উদ্ঘাটিত হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ব্যাংক-কোম্পানির কার্য হতে বিরত রাখার কোনো বিধান ব্যাংক কোম্পানি আইনে নেই। এ বিষয়ে নতুন ধারা সংযোজন করা প্রয়োজন। বিআরপিডি সার্কুলার ও সার্কুলার লেটার নং ১১/২০১৩ ও ১৮/২০১৩ অনুযায়ী পরিচালক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের যোগ্যতা-উপযুক্ততা ও ঘোষণা বিষয়ে সংশোধন প্রয়োজন।

সংশোধনীর সুপারিশমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংক  কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়ে কোনো সংজ্ঞা এবং বিধান না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর বা আলাদাভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগে তারা ঋণ পরিশোধ না করে কিংবা ঋণ পরিশোধে অহেতুক কালবিলম্ব করে সম্পূর্ণ আর্থিক খাতকে ঝুঁকিগ্রস্ত করছে। তাদের কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সৎ ও ভালো উদ্যোক্তা/ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বোপরি আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা ও বিধান সংযোজন করা হলে তাদের ওপর আলাদাভাবে নজরদারি করা ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। এবং তারা যেন নতুন ঋণ নিতে না পারে সে লক্ষ্যে তাদের তথ্য ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে বিনিময়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে আগাম সতর্ক করা যাবে। একই সঙ্গে অন্য কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক  স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া, অস্তিত্ব বিহীন কোম্পানির ঋণ, ঋণের অর্থের ভিন্নখাতে ব্যবহার, পাচার, নিরীক্ষকদের ভূমিকা, তাদের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ব্যাংক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুসরণীয় বিষয়, ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে একটি কম্প্রেহেনসিভ সার্কুলার জারি করবে। কমিটিতে পর্ষদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৫ খ ধারা এবং বিআরপিডি সার্কুলার নং ১১/২০১৩ সংশোধন করতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৩৭ ধারার অধীনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তালিকা প্রকাশ করতে পারবে। সংশোধনীর সুপারিশে বলা হয়, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে খেলাপিঋণ নিয়মিত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কতিপয় পরিচালক আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালক পদে নিযুক্ত বা বহাল থাকতে আগ্রহী হন। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে খেলাপি ব্যক্তির ব্যাংকের পরিচালক হওয়া/থাকা সমীচীন নয়। সংশোধনীতে এমন ধারা যুক্ত করা প্রয়োজন।

আইনের ১৭ ধারার আওতায় নোটিস প্রাপ্ত ব্যাংক- কোম্পানির পরিচালক কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে পরিচালক হলে তার নামে ওই ব্যাংক- কোম্পানিতে কোনো শেয়ার থাকে না বিধায় যে প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে তিনি পরিচালক ছিলেন তার শেয়ার সমন্বয়ের মাধ্যমে আদায় করার বিধান করলে খেলাপি ঋণ আদায়ে তাকে বাধ্য করা যাবে। ব্যাংকের পরিচালক খেলাপি হলে তাদের বা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারার আওতায় নোটিস প্রদান করা হলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট পরিচালক ঋণ পরিশোধ না করে তার পদ হতে পদত্যাগ করেন। ফলে উক্ত ধারার (৫) উপ-ধারার বিধান প্রয়োগ করে পরিচালক যে ব্যাংকের পরিচালক সেই ব্যাংকে তার নামে থাকা শেয়ার সমন্বয়ের মাধ্যমে ঋণ আদায় করা সম্ভব হয় না। এ লক্ষ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারার উপ-ধারা (৭) এর পর নতুন উপ-ধারা সংযোজন প্রয়োজন।  খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৭ ধারার আওতায় নোটিস দেওয়া হলে ঋণ পরিশোধ না করে পরিচালকের পদত্যাগ করার সুযোগ থাকা সমীচীন নয়। এক্ষেত্রে নতুন বিধিবিধান যুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসনের স্বার্থে ব্যাংকের পরিচালকের ঋণের বিষয়ে অধিকতর বিধিনিষেধ আরোপ করার লক্ষ্যে এই ধারার সংশোধন/পরিমার্জন/সংযোজন প্রয়োজন। কোনো  খেলাপি ঋণ গ্রহীতার অনুকূলে কোনো ব্যাংক- কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ ঋণ সুবিধা প্রদান করবে না মর্মে বিধান থাকলেও উক্ত বিধান লঙ্ঘনের ফলে শাস্তি কী হবে তার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। কেননা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রায়ই  খেলাপি ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দিয়ে থাকে। ৪৬ ধারা অনেক সময় বেনামি বা অস্তিত্ববিহীন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে প্রদান করা হয় অথবা ঋণের সুবিধাভোগী (ইবহবভরপরধৎু) ব্যতীত অন্য ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের অর্থ স্থানান্তরিত হয়ে ব্যাংক হতে অনেক বড় অঙ্কের অর্থ বের হয়ে যায়, কখনো উক্ত অর্থ পাচার হয়। সবশেষে ব্যাংকটিকে দেউলিয়া অবস্থায় নিয়ে যায়। এমন অনেক অনিয়ম ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উদ্ঘাটিত হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯(১)(চ) ধারার নির্দেশনা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও  কোম্পানি ঋণ মওকুফ, ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ কিংবা পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করে এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে অসংখ্য রিট পিটিশন দায়ের করায় ঋণ আদায় কার্যক্রম জটিল হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে উক্ত সমস্যা উত্তরণের লক্ষ্যে ধারাটির সংশোধন/পরিমার্জন প্রয়োজন। তাছাড়া, ব্যাংক-  কোম্পানি আইনে ‘বিশেষ ব্যাংক-কোম্পানি বা বিশেষ  শ্রেণির ব্যাংক-কোম্পানি’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এ বিষয়ে নতুন ধারা যুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর