রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

অনুবাদের একটা একাডেমি খুবই দরকার

হেলাল হাফিজ

অনুবাদের একটা একাডেমি খুবই দরকার

আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ; এই স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এবং নেতৃত্বে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ বিনা বাক্যব্যয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশকে স্বাধীন করেছিল। এই যে স্বাধীনতাযুদ্ধ, এর বীজতলা ছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। সেখান থেকেই অঙ্কুরিত হয়েছে বাঙালির সব আন্দোলন।

দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, এ ভূখন্ডের বাংলাভাষী মানুষের স্বকীয়তা, ভাষা, সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দিতে সচেষ্ট ছিল। একটা জাতিকে নিষ্ক্রিয় করতে প্রথম প্রয়োজন তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভেঙে দেওয়া। শিক্ষাব্যবস্থা তছনছ করে দেওয়া। ভাষা শেষ করে দেওয়া। পশ্চিম পাকিস্তানিরাও তাই করেছিল। কিন্তু পারেনি। জিন্নাহ যখন ঢাকায় এসে বললেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, গর্জে উঠল এ ভূখন্ডের মানুষ। প্রচন্ড আন্দোলন শুরু হলো। শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। গুলি হলো। রাজপথে শহীদ হলেন অনেক ছাত্র। এই রক্ত¯œাত পথ ধরেই পরে তৈরি হয় একের পর এক আন্দোলন। শিক্ষা আন্দোলন। শেখ মুজিবের ছয় দফা আন্দোলন। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা আমাদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি বহুদিন। ভাষা আন্দোলন তারও আগে হয়েছে। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য ও ভাষার উৎকর্ষ সাধনে আমাদের যত দূর যাওয়ার কথা ছিল, তা পারিনি। এখন সামনে তাকানোর সময়। পৃথিবীর মানুষ যাতে আমাদের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয় এজন্য নিজেদের তৈরি হতে হবে। এ জাতিকে সুসংগঠিত করে সুসংস্কৃতির চর্চা আরও বাড়িয়ে কীভাবে একে আরও উন্নত করা যায় তা ভাবতে হবে। ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য- এগুলোকে আরও উন্নত করার জন্য কাজ করতে হবে সবাইকে। যেসব প্রতিষ্ঠান এগুলোর দায়িত্বে আছে যেমন বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, সংবাদপত্র, শিক্ষকসমাজ, ছাত্রসমাজ, কবি, সাহিত্যিক- সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। আমাদের এত বড় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো কালজয়ী সাহিত্যকর্ম বা শিল্পকর্ম আজও আমরা রচনা করতে পারিনি। এক ধরনের দায়সারা কাজ করা যেন আমাদের পেয়ে বসেছে। কোনো কিছু চূড়ান্ত উৎকর্ষের সঙ্গে করার আকাক্সক্ষা যেন আমাদের মধ্যে কাজই করে না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এটা ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক পর্যায়ে গেলে তা জাতিকে প্রভাবিত করবে। জাতি দুর্বল হবে। নান্দনিক দিক দিয়ে ঘাটতি থেকে যাবে। এ জনগোষ্ঠীর জন্য রুচিসম্মত সংস্কৃতির জোগান দেওয়া, তাদের সুশিক্ষিত করে তোলা- এ কাজগুলো আমরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করতে পারছি না। অনেক সময় চলে গেছে। আমাদের হাতে সময়ও খুব কম। জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। যা করার দ্রুত করতে হবে। ভাষা একটা জাতির শিল্প-সংস্কৃতির মূল উপাদান। অনেক বড় শক্তি। এ শক্তিটা শেষ করে দিতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। আরেকটু সময় পেলে হয়তো তারা সফলও হতো। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিপক্ষে একটা প্রতিপক্ষ তখন তৈরি হচ্ছিল। এখনো বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অনেক চক্রান্ত আছে। সেখানে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। অন্য কোনো ভাষা যেন আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ না করে। আমরা যেন আমাদের ভাষাকে সুন্দরভাবে লালনপালন করি। একটা সুন্দর, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন প্রমিত ভাষা যেন তৈরি হয় আমাদের। ভাষা নিজে তো নির্বাক। মানুষ এটাকে ব্যবহার করে সচল রাখে। আমাদের দায়িত্ব এ ভাষাটাকে প্রাঞ্জল করা, আরও শক্তি দান করা। আমাদের সাহিত্য, গান, কবিতা, উপন্যাসের মাধ্যমে তা করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনেও করতে হবে। বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো ভালো লেখা আছে। সেগুলো বিশ্বদরবারে আমরা পৌঁছাতে পারছি না শুধু ভাষাটা বাংলা বলে। এজন্য আমাদের মানসম্মত সাহিত্যগুলোকে একাধিক বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। এটা বাংলা একাডেমি করতে পারে। অনুবাদের জন্য আলাদা একাডেমিও হতে পারে। এটা খুবই দরকার। না হলে আমরা যত ভালোই লিখি না কেন, তা বিশ্বদরবারে পৌঁছাবে না। পাশাপাশি পৃথিবীর অন্য ভাষার উন্নত সাহিত্যকর্মকেও আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। শুধু এ কাজের জন্যই একটা একাডেমি প্রয়োজন। লেখক : কবি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর