শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বাড়ছে বাংলায় রায় লেখা

উচ্চ আদালতে সব রায় বাংলায় লেখেন দুই বিচারপতি, অনুবাদ সেল গঠনের উদ্যোগ

আরাফাত মুন্না

সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে হাই কোর্ট বিভাগের রায় ও আদেশ ভান্ডারে (ক্যাটাগরি) বাংলা ভাষায় সর্বশেষ যে রায়টি দৃশ্যমান হয় সেটি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চের। ‘নিগার সুলতানা বনাম রাষ্ট্র’ শিরোনামের মামলার পুরো রায়টিই দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষায়। আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে সর্বশেষ চলতি বছর পিলখানা হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তির প্রায় ৩০ হাজার পৃষ্ঠার রায়ের একটি অংশও বাংলায় দেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর বেঞ্চের তিন বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী নিজের ১৬ হাজার ৫৫২ পৃষ্ঠার অংশ বাংলায় লিখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে। দুজন বিচারপতি নিজেদের সব রায় ও আদেশ দিচ্ছেন বাংলায়।

অন্যদিকে অধিকাংশ বিচারপতির ইংরেজি ভাষায় দেওয়া রায় ও আদেশ সাধারণ মানুষের বোধগম্য করাতে তা অনুবাদ করে দেওয়ার চিন্তা করছে সুপ্রিম কোর্ট। এজন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি অনুবাদ সেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে নিযুক্ত ৯৭ জন বিচারপতির মধ্যে ১০ জন কমবেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে আলোচনায় রয়েছেন। তারা হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি ড. কাজী রেজা-উল হক, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।

এর মধ্যে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রায় ও আদেশ বাংলায় লিখে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এর পরই আছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। কয়েক বছর ধরে তিনিও সব রায় ও আদেশ বাংলায় দিচ্ছেন। এ দুই বিচারপতি বিভিন্ন রায়ে বাংলায় রায় দেওয়ার যৌক্তিকতাও তুলে ধরেছেন।

সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। সংবিধানেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। তবে আজও উচ্চ আদালতে পূর্ণাঙ্গভাবে এ বিধান কার্যকর হয়নি। আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আট বছর আগে আইন কমিশন থেকেও সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছিল। আইনজ্ঞরা বলছেন, অনেক অপেক্ষার পর বিচারপতিরা বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটা ভালো দিক। বাংলায় রায় ও আদেশের বিষয়ে নতুন প্রজন্মের আইনজীবীদের বেশি ভূমিকা রাখতে হবে বলেও মনে করেন আইনজ্ঞরা।

সুপ্রিম কোর্টসূত্রে জানা গেছে, ’৯০-এর দশকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল রিপোর্টস ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্যানুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন।

বাংলায় রায় লেখার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র স্পেশাল অফিসার (অতিরিক্ত জেলা জজ) মো. সাইফুর রহমান বলেন, রায় ও আদেশ বাংলায় দিতে বিচারপতিদের কোনো আইনি বাধা নেই। তবে তারা ইংরেজি বা বাংলা কোন ভাষায় রায় দেবেন- সেটি তাদের নিজস্ব বিষয়। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের দেওয়া ইংরেজি রায় ও আদেশ বাংলায় অনুবাদ করতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে অনুবাদ সেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

বাংলায় রায় দেওয়ার যৌক্তিকতা : বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাই কোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই সব আদেশ ও রায় বাংলায় দিয়ে আসছেন। ‘জুয়েল শিকদার বনাম রাষ্ট্র’ শিরোনামে মামলার রায়ে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন কেন বাংলায় রায় দেওয়া উচিত সে প্রসঙ্গে লিখেছেন, আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি প্রবচন আছে ‘বাঙালিকে হাই কোর্ট দেখানো’। সময় পরিবর্তন হয়েছে তবে বাঙালিকে হাই কোর্ট দেখানোর প্রবণতা এখনো পরিবর্তন হয়নি; যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিচারপ্রার্থীদের বোধগম্য ভাষায় বিচারকার্য পরিচালনা না হওয়ায় এখনো বোধগম্যতার অভাবে বাঙালি স্বাধীনতার এত বছর পরও হাই কোর্ট দেখানোর করুণ অভিজ্ঞতার নাগপাশ থেকে বের হতে পারেনি। রায়ে বলা হয়, বিচারপ্রার্থীরা তাদের বোধগম্য ভাষায় বিচার না পাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে বিভ্রান্ত হওয়ায় আদালতগুলোয় এত মামলা-মোকদ্দমার জট। এ জট খুলতে পারে শুধু তাদের নিজস্ব ভাষায় বিচারের বাণী প্রকাশ এবং প্রচারে।

রায়ে তিনি আরও লেখেন, ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণ আজও জাতিকে চরমভাবে নাড়া দেয়। সেদিন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরের বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পন্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে। পরে তা সংশোধন করা হবে।’

বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের তৃতীয় বিচারক হিসেবে শুরু করে এখন নিয়মিতভাবে বাংলায় রায় ও আদেশ লিখে আসছেন। এর সংখ্যা ইতিমধ্যে কয়েক শ ছাড়িয়েছে। ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর দেওয়া এক রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল লিখেছেন, পৃথিবীর সকল দেশের সংসদ তথা রাষ্ট্র মাতৃভাষায় আইন প্রণয়ন করে এবং সে দেশের আদালত সে ভাষায় তার ব্যাখ্যা প্রদান করে। আরও পরিষ্কার ভাষায় বলতে গেলে, জাপানিরা জাপানি ভাষায় আইন প্রণয়ন করে, আদালতও তাদের মাতৃভাষায়ই আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে। চীনেও একই রকম। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের সংসদ বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়ন করলেও উচ্চ আদালত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরভাষা তথা বিজাতীয় ভাষা ইংরেজিতে আদালতের ব্যাখ্যা প্রদান করে।

রায়ে তিনি লেখেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ যথা- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। যেহেতু সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা বাংলা তাই আইন-আদালতের ভাষাও হবে বাংলা। রায়ে তিনি আরও লেখেন, বর্তমানে জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ তাদের সব কার্যক্রমে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছে। অন্যদিকে বিচার বিভাগের মধ্যে নিম্ন আদালতগুলো সংবিধান মোতাবেক বাংলায় রায় ও আদেশ প্রদান করে যাচ্ছে। শুধু উচ্চ আদালত তথা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ কী এক অজানা কারণে অদ্যাবধি বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করে চলেছে।

আইনজ্ঞদের অভিমত : উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাংলায় রায় দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে যেসব বিচারপতি বাংলায় রায় লিখছেন, আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। এ ছাড়া অন্য যারা এখনো ইংরেজিতে রায় লিখছেন তাদের অনুরোধ করব বাংলায় রায় লিখতে। আইন এবং রেফারেন্সের কিছু সমস্যা ছাড়া বাংলায় রায় লিখতে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন এই আইনজ্ঞ।

জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাই কোর্টের অনেক বিচারপতিই এখন বাংলায় রায় বা আদেশ দিচ্ছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে বাংলায় রায় দিতে তারা আগ্রহবোধ করছেন। তিনি বলেন, বিচারপতিরা বাংলা না ইংরেজিতে রায় দেবেন, এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে বাংলায় রায় লিখলে সাধারণ মানুষের বুঝতে সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে আইনেও কোনো বাধা নেই।

জানতে চাইলে হিউম্যানরাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচারপতিরা এখন বাংলায় রায় লিখছেন, এটা খুবই ভালো দিক। তবে এখনো পুরোপুরি বাংলায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। অনেক আইন ও রেফারেন্স ইংরেজিতে। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে পুরোপুরি বাংলার প্রচলন করতে হলে নতুন প্রজন্মের আইনজীবীদের বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর