রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বই পড়ার আন্দোলন

হানিফ সংকেত

বই পড়ার আন্দোলন

আমরা নানাবিধ আন্দোলনের কথা বলি। অধিকাংশই রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা কোনো কিছু প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন। আবার আছে অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আর এক ধরনের আন্দোলন আছে যেখানে দলনের ভয় নেই বরং দোলনে মনে প্রশান্তি আনে। মানুষকে করে পুলকিত, করে আলোকিত। আর এই আন্দোলন হচ্ছে বই পড়ার আন্দোলন। যে আন্দোলন করেছিলেন পলান সরকার। যাকে আমরা ২০০৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম ইত্যাদি-তে দেখিয়েছিলাম। মাইলের পর মাইল হেঁটে তিনি গ্রামে গ্রামে বই বিতরণ করতেন। আবার পড়া শেষে পুরনো বই ফেরত নিয়ে নুতন বই দিয়ে আসতেন। যেহেতু গ্রামাঞ্চলে বইমেলা হয় না, তাই ব্যক্তি উদ্যোগে পাঠাগার করে এবং বই বিতরণ করে মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন তিনি আমৃত্যু। আমাদের বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে, স্টল বেড়েছে, বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এত এত বইয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন বই কটি? আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শিকড় এসব নিয়ে কটি বই মেলায় পাওয়া যায়, যা পড়ে তরুণ সমাজ দেশ সম্পর্কে, আমাদের শিকড় সম্পর্কে জানতে পারবে? আমাদের ফেসবুক আর ইউটিউবের ফাঁদে পড়ে আমরা আমাদের শিকড়কে ভুলতে বসেছি। এখন শীত এলে কেউ গ্রামে যেতে চায় না, যায় বিদেশে। কিংবা মধ্যবিত্ত হলে কক্সবাজার, রাঙামাটি নইলে বান্দরবান কিন্তু কেউ নিজের গ্রামে যেতে উৎসাহী হয় না। এমনকি শীতেও না। কথায় আছে, ‘শীতের আদর-গায়ের চাদর’, ‘শীতকালের পিঠাপুলি, সঙ্গে মধুর মায়ের বুলি’, কিন্তু এসব শীতের বচন শহুরে রচন নয়, গ্রাম্য কবির যতন করা কথন-যেন রতন হয়ে ফুটে উঠেছে। দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ শর্ষে ফুল, রসের হাঁড়ি, খেত ভরা সবজি-এসবই শীতের অন্তর ভেজা দৃশ্য। আমাদের দেশের প্রতিটি গ্রামের দৃশ্যই ছবির মতো। এখানেই আমাদের শিকড়। কিন্তু আমাদের এই শিকড়, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি এসব নিয়ে লেখা বই খুব একটা চোখে পড়ে না। অথচ আজকাল মেলায় অনেক লেখকের উদ্দেশ্যেই অনেককে প্রশ্ন করতে দেখা যায়, ‘এবারের মেলায় কয়টা বই?’ উত্তরদাতা বইয়ের সংখ্যা বললেই প্রশ্নকর্তার আর যেন কিছু জানার নেই। সোজা হেঁটে চলে যান। বইয়ের বিষয়ের চাইতে এদের কাছে সংখ্যাটাই মুখ্য। আবার অনেক লেখক আছেন যারা নিজের লেখা বইয়ের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত। বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন এবারের মেলায় তিনি কটি বই লিখেছেন এটাই তার কাছে মুখ্য। টিভি নাটকের অনেক নির্মাতার মতো, কেউ ৫০০ পর্ব, কেউ ১০০০ পর্ব করে উচ্ছ্বসিত এবং গর্বিত। কিন্তু এই হাজার পর্বের মধ্যে দর্শক হয়তো একটি পর্বও ঠিকভাবে দেখেননি। এতে নির্মাতারও কিছু যায় আসে না। ব্যবসার জন্য নির্মাণ, তেমনি সংখ্যার জন্য প্রকাশ। এই শ্রেণির লেখকরা আবার ব্যবসার দিকে খুব একটা তাকান না। অনেক ক্ষেত্রে নিজের অর্থে একাধিক বই প্রকাশ করেন। এতেই তার আনন্দ-তিনি লেখক হয়েছেন। তবে অনেকে আছেন যারা প্রকৃত অর্থেই একাধিক বই প্রকাশ করেন। যেহেতু বইমেলা ছাড়া বই খুব একটা প্রকাশিত হয় না তাই সারা বছরের পত্রিকায় লেখা কলাম বা পুরনো জমে থাকা লেখাগুলো নিয়ে অনেকেরই একাধিক বই প্রকাশিত হয়। তবে বইমেলায় যত বই-ই প্রকাশিত হোক না কেন, প্রয়োজন পাঠক। বইমেলায় যে ভিড় পরিলক্ষিত হয় তাদের সবার হাতেই অন্তত একটি করে বই দেখতে চাই। যে বই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কথা বলবে। যে বইতে থাকবে নুতন বইয়ের ঘ্রাণ, থাকবে এই মাটির ঘ্রাণ। আর একটি কথা, আমাদের দেশে যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখনই টনক বাবাজি নড়ে উঠে অর্থাৎ ধাক্কা না খেলে আমাদের হুঁশ হয় না। বিপথ, কুপথ থেকে সুপথে আসার জন্যেই প্রয়োজন সময়মতো টনক নড়া। আর এসব বিষয় নিয়েই বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত কলামগুলো নিয়ে বইমেলায় প্রকাশিত আমার এবারের বই ‘টনক নড়াতে টনিক’। প্রকাশ করেছে অনন্যা প্রকাশনী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর