মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ভুল তথ্যে পানির দাম বাড়াচ্ছে ওয়াসা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঢাকা ওয়াসায় এক ইউনিট পানি উৎপাদনে খরচ হয় ১৬ টাকা ২১ পয়সা। পানি উৎপাদন খরচের সঙ্গে কর্মচারীর বেতন-ভাতাসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে এক ইউনিটের দাম ধরা হয়। কিন্তু পানির মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবনায় ওয়াসা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে উৎপাদন খরচ উল্লেখ করেছে প্রায় ২৫ টাকা। প্রতিবছর লাভে থেকেও ভুল তথ্য দিয়ে পানির মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগ উঠেছে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। গত বছর ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান পানির মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব এনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বৈদেশিক ঋণের ডিএসএল (কিস্তি) বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আয় দিয়ে ডিএসএল পরিশোধ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখীকরণের লক্ষ্যে ঢাকা ওয়াসা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিছু প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।’ বাস্তবায়িত প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পদ্মা (জশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, তেঁতুলঝোরা-ভাকুর্তা অয়েল ফিল্ড, অন্তর্বর্তীকালীন পানি সরবরাহ প্রকল্প।’ চলমান প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া পাইপলাইনে রয়েছে জানিয়ে পাঁচটি প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১৪ জানুয়ারি পানির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্টীকরণের নির্দেশনা দিয়ে ওয়াসার এমডিকে চিঠি দেয়। মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির জবাবে ১৬ জানুয়ারি পানির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যাসহ জবাব দেন ওয়াসার এমডি। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন ও ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন, পরিবহন ও সঞ্চালন লাইন রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় ধরে প্রতি ইউনিট বা প্রতি এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ প্রায় ২০ টাকা। দাফতরিক রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য ব্যয়সহ প্রতি এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২৫ টাকা।’

ঢাকা ওয়াসার নিযুক্ত ফিনানশিয়াল অডিট ফার্ম ‘হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং’-এর গত বছর ৩০ জুন ২০১৮-১৯ সালের অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেখানে দেখা যায়, এক বছরে ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ, ঋণের কিস্তিসহ মোট ব্যয় ১ হাজার ৩৯০ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার ২৯১ টাকা। ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম অপারেশন কন্ট্রোল ডিভিশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে গড়ে প্রতিদিন পানির চাহিদা ছিল ২২০-২৩৫ কোটি লিটার। সর্বোচ্চ চাহিদা হিসাবে এক বছরে পানির প্রয়োজনীয়তা ছিল ৮৫ হাজার ৭৭৫ কোটি লিটার। এই হিসাবে প্রতি এক হাজার লিটার বা এক ইউনিট পানির উৎপাদন খরচ হয় ১৬ টাকা ২১ পয়সা। প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ ১৬ টাকা ২১ পয়সা হিসাবে ওয়াসা গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লাভ করে ৩৯ কোটি ৮৭ লাখ ৬৮ হাজার ৮০৪ টাকা। প্রতি ইউনিট পানি আবাসিকে ১১ টাকা ৫৭ পয়সা এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ৩৭ টাকা ৪ পয়সায় বিক্রি করে ঢাকা ওয়াসা এই মুনাফা করেছে। অথচ মন্ত্রণালয়ে ওয়াসার এমডি স্বাক্ষরিত চিঠিতে পানি উৎপাদনসহ খরচ উল্লেখ করা হয়েছে ২৫ টাকা। ভুল তথ্য উপস্থাপন করে দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাব আনা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠান লাভে থাকলেও আবাসিক সংযোগে পানির দাম ১১ টাকা ৫৭ পয়সার জায়গায় ২০ টাকা এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ৩৭ টাকা ৪ পয়সার জায়গায় ৬৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। যেসব প্রকল্প ঋণের কিস্তির কথা বলা হয়েছে, সেগুলো আগের অর্থবছরগুলোতেও পরিশোধ করেছে ওয়াসা। ঢাকা ওয়াসার ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মোট পানির ৭০ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ পানি আসে ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করে। ওয়াসা ৭০ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে স্থায়ীভাবে বসানো পাইপের মাধ্যমে বিনা মূল্যে আহরণ করে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল ছাড়া বাদবাকি দৈনন্দিন খরচ প্রায় শূন্যের কোঠায় থাকায় প্রতি ইউনিট পানির উৎপাদন খরচ হয় খুবই সামান্য। ওয়াসা ঢাকা শহরে পানির মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিকতা হিসেবে নয়াদিল্লি, কাঠমান্ডু, সিউল, লন্ডনসহ কয়েকটি শহরে প্রতি ইউনিট পানির মূল্য উল্লেখ করেছে। সেখানে দেখা যায়, দিল্লিতে পানির দাম ২৬ দশমিক ৩৬ রুপি, নেপালে ৩০ রুপি। তবে এসব শহরে ট্যাপ থেকে মানুষ সরাসরি পানি পান করতে পারে। সেখানে ঢাকা ওয়াসার পানি দুর্গন্ধ, নোংরায় ভরা। দীর্ঘ সময় ফুটিয়ে এই পানি পান করায় গ্যাস খরচ হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। এ ব্যাপারে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ খবর