শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
শিশু রুশদি নেই লড়ছেন মা-বাবা

রাজধানীতে ভবনে আগুন তিনজনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে ভবনে আগুন তিনজনের মৃত্যু

আগুনে পুড়েছে সবকিছু। আর্তনাদ-কান্না। ডানের শিশু রুশদি মারা গেছে। বাবা-মা দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর ইস্কাটনের একটি ভবনে লাগা ভয়াবহ আগুনে শিশুসহ তিনজন পুড়ে মারা গেছেন। এরা হলেন- আফরিন জান্নাত যুঁথি (১৭), আবদুল কাদের লিটন (৪৫) ও এ কে এম রুশদী (৫)। এ ছাড়া দগ্ধ ও ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে আরও পাঁচজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরা হলেন- শহিদুল  ইসলাম রনি (৪০), তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৫), সুমাইয়া আক্তার (৩০), মাহাদি (৯) ও মাহমুদুল হাসান (৯ মাস)।

গতকাল ভোররাত ৪টার দিকে দিলু রোডের ৪৫/এ নম্বর বাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস  বলছে, ওই ভবনের গ্যারেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত। চিকিৎসকরা বলছেন, আগুনে শহিদুলের শরীরের ৪৩ শতাংশ এবং তার স্ত্রী জান্নাতুলের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া সুমাইয়া, মাহাদি ও মাহমুদুল ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন। তারা ঢামেক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আধঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন নেভানোর পর উদ্ধারকর্মীরা ওই ভবন থেকে এক শিশুসহ তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। এদের মধ্যে একজন পুরুষের মৃতদেহ পাওয়া যায় ভবনের গ্যারেজে। একটি শিশুসহ দুজনের মৃতদেহ ছিল তিনতলার সিঁড়িতে। ওই বাড়ির গ্যারেজে থাকা পাঁচটি গাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। ভবন থেকে ১৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ছয়তলাবিশিষ্ট ওই আবাসিক ভবনের তিনতলা পর্যন্ত গার্মেন্টস ছিল, যেখানে বিপুল পরিমাণে দাহ্য পদার্থ ছিল। আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। নিহত যুঁথির চাচা মো. সুরুজ্জামান বলেন, যুঁথির বাবার নাম জাহাঙ্গীর আলম এবং মায়ের নাম লাল বানু। জাহাঙ্গীর পূর্ত ভবনের প্রশাসনিক সেকশনে চাকরি করেন। ওই দম্পতির মেয়ে যুঁথি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। যুঁথির ভাই আশিক আপন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন। তারা ওই ভবনের ছাদের একটি কক্ষে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগলে যুঁথি আতঙ্কিত হয়ে যায়। পরে তাড়াহুড়া করে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামে। আর ওপর থেকে বাবা ও ভাই গ্রিল বেয়ে বাইরে দিয়ে নামেন। তারা দুজনই সামান্য আহত হন। মা উপর দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন। তার পা ও কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’ যুঁথির বাবার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা ভবনের ছাদ থেকে পাশের ভবনে লাফিয়ে পড়ি। আমাদের আগেই মেয়েটি সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে চলে গেছে। পুড়ে যাওয়া মেয়েটিই আমার যুঁথি।’ মৃত লিটনের শ্যালক জহির আলম বলেন, ওই ভবনের দোতলায় ‘ক্লাসিক ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটা বায়িং হাউসের অফিস সহকারী ছিলেন তার ভগ্নিপতি লিটন। নিচতলায় গ্যারেজের পাশে একটি কক্ষে তিনি থাকতেন। লিটনের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর থানার পশ্চিম নন্দনপুরে। তার স্ত্রীর নাম মরিয়ম বেগম। ওই দম্পতির রনি ও সোনিয়া নামে দুটি সন্তান রয়েছে। তারা গ্রামের বাড়ি থাকেন। দগ্ধ জান্নাতুল ফেরদৌসের ভাই শাহাদাত হোসেন বিপ্লব বলেন, ‘শিশুটির শরীর এতটাই পুড়ে গেছে যে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু আমার ভাগ্নেকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বোন জান্নাতুল ও ভগ্নিপতি রনিও আগুনের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন। তাদের ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমি আহত একজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। তিনি বলেছেন, আগুন লাগার পর রনিরা তিনতলা থেকে বের হওয়ার সময় রুশদী ওদের হাত থেকে ছিটকে পড়ে।’

দগ্ধ রনির বাবা দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র প্রোডাকশন ম্যানেজার এ কে এম শহিদুল্লাহ বলেন, তার ছেলে রনি পুলিশ প্লাজায় ভিআইভিপি এস্টেট ম্যানেজমেন্ট নামে একটি কোম্পানির ফাইন্যান্স ম্যানেজার। আর পুত্রবধূ জান্নাতুল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অর্থ বিভাগে চাকরি করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর থানার ইটনায়। ওই দম্পতির ছেলে রুশদীর খোঁজ মেলেনি।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘ইস্কাটনের আগুনের ঘটনায় তিনটি মরদেহ পাই। এর মধ্যে দুটি মরদেহ পুরোপুরি পুড়ে গেছে। আরেকজন দগ্ধ না হলেও তার ইনহেলেশন বার্ন ছিল। সবাই শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। পুড়ে যাওয়াদের মধ্যে একজন শিশু এবং অপরজন মেয়ে। তারা দুজনই প্রথমে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। পরে পুড়ে যায়। আমরা পোড়া দুজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছি।’ ওই বাড়ির কেয়ারটেকার লুৎফর রহমান বলেন, ‘নিচতলায় গাড়ির গ্যারেজ থেকে আগুন লাগে। পাঁচটি প্রাইভেটকার ও দুটি মোটরসাইকেল পুড়ে গেছে। তিনজন মারা গেছে।

বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করছি। নিচতলায় আগুন লাগার পর আমি বাইরে বের হয়ে সবাইকে চিৎকার করে বের হতে বলছি। হু হু করে আগুন নিচ থেকে ওপরে উঠে যায়।’

হাতিরঝিল থানার এসআই খন্দকার সেলিম শাহরিয়ার জীবন স্টালিন বলেন, ‘মৃত তিনজনের মধ্যে শিশুসহ দুজন পুরোপুরি পুড়ে গেছে, যা দেখে শনাক্ত করার মতো নয়। তাই আমরা পোড়া দুজনেরই ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য ফরেনসিক বিভাগকে নমুনা সংগ্রহ করতে বলেছি। এ ছাড়া একজন পোড়েননি। সম্ভবত ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন।’

সর্বশেষ খবর