শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
ম তা ম ত : সেলিম দেলোয়ার স্মরণে

বিভীষিকাময় দিনটি হোক চেতনার বাতিঘর

শফী আহমেদ

আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিভীষিকাময় দিন। ১৯৮৪ সালের এই দিনটি ছিল এ দেশের ছাত্রসমাজের জন্য এক দুঃখজনক অধ্যায়। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। বিকালে ছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিছিলের কর্মসূচি। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আহূত ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সব ছাত্র সংগঠনের পৃথক পৃথক মিছিল বিকাল ৪টার মধ্যে মধুর ক্যান্টিন এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় পৃথকভাবে সমবেত হয়। কেন্দ্রীয় নেতারা মধুর ক্যান্টিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে

বক্তৃতা করেন, সমাবেশকে উজ্জীবিত করেন। এরপর মূল মিছিল শুরু হয়। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আমার গা শিউরে ওঠে। সেদিন কেন জানি আমার মিছিলে যেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা, মিছিলে না গেলে কি হয়? আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে আমার মনের অবস্থা খুলে বলেছিলাম। কিন্তু তারাও আমাকে অনুরোধ করলÑ যা হয় হবে, মিছিলে থাক। ডান-বাম খেয়াল রাখ। মধুর ক্যান্টিনের পাশেই ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের মাঠে আমাদের জমায়েত ছিল, সেই জমায়েতে বক্তব্য দিলাম। বললাম, যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করতে হবে। তারপর খ- খ- মিছিল মধুর ক্যান্টিনের সামনে সমবেত হলো। নেতারা বক্তব্য রাখলেন। কবি মোহন রায়হান আবৃত্তি করলেন একটি বিপ্লবী কবিতাÑ ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য আজ কোনো পরিতাপ নেই, আমাদের জন্মের জন্য আজ কোনো ভালোবাসা নেই, আমাদের ধ্বংসের জন্য আজ কোনো প্রতিকার নেই, আমাদের সবকিছু আজ শুধু ছলনার, ব্যর্থতার ক্লেদ নিয়ে আসে। আজকে এখানে একজন শিক্ষক জন্মাক, আজকে এখানে একজন বুদ্ধিজীবী থাক, আজ নবজন্ম হোক এ দেশের লেখক-কবির আর তারা অন্ধকারে ঝলসিত আগ্নেয়াস্ত্রের মতো হোক স্পর্ধিত; স্পর্ধিত হোক আজ তারা স্পর্ধিত হোক।’ মিছিলটি শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে দিয়ে রোকেয়া হল পেরিয়ে টিএসসি দিয়ে কার্জন হলের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলের সামনে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা, ডাকসু ভিপি আক্তারুজ্জামান, খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক, মুনির উদ্দীন আহমেদ, ফজলে হোসেন বাদশা, আনোয়ারুল হক, আবদুল মান্নান, শিরীন আখতার, মোস্তাক হোসেন, মুকুল বোস, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর প্রমুখ। মিছিলটি কার্জন হল পার হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। দাঙ্গা পুলিশ মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেয়। এ যেন মিছিল নয়, পুলিশি ঘেরাওয়ের মধ্যে একটি জেলখানা। তার পেছনেই ছিল পুলিশের পুলিশবিহীন ট্রাক। আমরা ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের ভাগ্যে! মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে, আকস্মিক পুলিশের পুলিশবিহীন ট্রাকটি মিছিলের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হলো খুনি জান্তার নির্দেশে। ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেন। চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেল আমাদের সাথী বাসদ ছাত্রলীগের নেতা আবদুস সাত্তার খান, ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান হাবীবসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্রকর্মী। সে এক নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ! সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনের লড়াইয়ের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করল, নির্বিচারে লাঠিচার্জ করল, কে নেতা কে কর্মী সেই লাঠিচার্জে কোনো বাছবিচার ছিল না। ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ারের লাশ পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। তার পরের ইতিহাস আরও নিষ্ঠুর-নির্মম। সেই লাশগুলো তাদের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ পাহারায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং দাফন করা হলো। আজ সেলিম-দেলোয়ারের শহীদ হওয়ার দিনে তাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সেলিম-দেলোয়ারের আত্মদান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের হারাতে হয়েছে বহু নেতা-কর্মীকে। সেলিম-দেলোয়ারসহ অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রে। আজকের বাস্তবতায় বলতে হয় বাংলাদেশের কোনো কোনো ক্ষেত্র বিতর্কিত কর্মকান্ডে জর্জরিত। কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। নানারকম কেলেঙ্কারিতে দেশের মানুষ বিব্রত। আমরা যারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে আন্দোলন করেছিলাম সেই রকম গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে সরকারের উন্নয়নের সুফল ম্লান হতে চলেছে। তবুও মুজিববর্ষে আমরা আশা করব বঙ্গবন্ধুর যে চেতনা, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনাকে ধারণ করে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেলিম-দেলোয়ারদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। সাড়ে তিন দশক আগের সেই বিভীষিকাময় দিন হোক আমাদের চেতনার বাতিঘর।

লেখক : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা এবং আওয়ামী লীগ নেতা।

সর্বশেষ খবর