রবিবার, ১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ক্যাসিনো ব্রাদার্স পাপিয়ার পর কে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্যাসিনো ব্রাদার্স পাপিয়ার পর কে

ক্যাসিনোকান্ডের মূল হোতা টু ব্রাদার্স এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়া এবং বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার পর কে? এ আলোচনা এখন আওয়ামী লীগের ভিতরে-বাইরে সর্বত্র। শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে চাঁদাবাজির দায়ে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বহিষ্কার, ক্যাসিনোকান্ডে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের অব্যাহতি ও গ্রেফতার। মাঝে কিছু সময়  বিরতির পর পতিতাবৃত্তি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার অভিযোগে যুব মহিলা লীগের নেত্রী পাপিয়াকে গ্রেফতার করার পর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে অন্য অপকর্মকারীদের সম্পর্কে। খোঁজা হচ্ছে এনু, রূপন, পাপিয়াদের গডফাদার ও গডমাদার কারা? তবে এরই মধ্যে গ্রেফতারের পর এনু, রূপন আর এখন পাপিয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ভয়ংকর সব তথ্য। গোয়েন্দাদের চোখ কপালে ওঠা এসব তথ্যের ভিত্তিতেই অপরাধজগতের গডফাদারদের পাকড়াও করা হবে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। অন্যদিকে জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া জানিয়েছেন, এমপি মনোনয়ন পেতে তিনি খরচ করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। প্রভাবশালীদের ডেরায় পাঠিয়েছেন দেশি-বিদেশি সুন্দরী। জানা গেছে, অপরাধ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু সময় বিরতির পর এবারের চলমান অভিযানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতা অনিয়ম-দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজিতে জড়িত, তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অভিযানের পরবর্তী লক্ষ্য কে তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। গা ঢাকা দিচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। কেউ বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টাও করছেন বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেখুন, দেশ এবং দেশের মানুষের নিরাপত্তাই র‌্যাবের প্রতিটি সদস্যের মূল লক্ষ্য। অস্ত্র ও মাদকে জড়িত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান চলছে।’ গোয়েন্দাসূত্র বলছে, আঙ্গুল ফুলে হঠাৎ করেই কলাগাছ হয়েছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, এমন ব্যক্তিদের ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এসব ব্যক্তির আমলনামা দফায় দফায় যাচাই-বাছাই করে জমা দেওয়া হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে। এসব ব্যক্তির তালিকায় রাজনীতিবিদের বাইরে রয়েছেন সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও সংস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ে চাকরিরত কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে সরকারের ওপরমহলের সবুজ সংকেতের ভিত্তিতেই তথ্যানুসন্ধানের কাজে হাত দিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা যে-ই হোক না কেন, যথাযথ প্রমাণ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া গেছে। বিশেষ করে মাদক, অস্ত্র ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে কালো টাকার মালিক হয়ে দেশের মানুষের জন্য অশান্তির কারণ হয়েছেন এমন ব্যক্তিরা আমাদের টার্গেট।’ এদিকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক কারবার, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কেউ কেউ এখন দেশে ও দেশের বাইরে নিরাপদ অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ বড় নেতাদের কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করছেন, তাদের বিপদের কোনো আশঙ্কা আছে কি না। শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও অপকর্মকারীদের ভিতরে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত জেলা-উপজেলার নেতারা নিজেদের রক্ষা করতে এখন ঢাকায় হাই লেভেলে লবিং-তদবির শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন, ক্যাসিনো-ঝড়ের পর যুব মহিলা লীগের পতিতাবৃত্তিসহ অস্ত্র-মাদক ব্যবসা ধরা পড়ায় কঠোর হয়েছেন সরকারপ্রধান। অনির্ধারিত আলোচনায় সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও দলের সিনিয়র নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি রাত-দিন পরিশ্রম করছি। মানুষের জন্য কাজ করছি। আর দলের নাম ভাঙিয়ে সরকারের বদনাম করবে এটা বরদাস্ত করা হবে না। কে কোথায় কী করছে সব তথ্য আমার কাছে আসছে। আমি কাউকে ছাড়ব না।’ সূত্রগুলো বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর অ্যাকশন শুরু হয়েছে। এখানে দলের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতারই বা মন্ত্রী-এমপিদের কিছু করার নেই। শুদ্ধি অভিযানের বিষয়টি সরাসরি দেখভাল করছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। র‌্যাবের হাতে পাপিয়া ধরা পড়ার পর গণভবনে সাক্ষাৎ করতে যান যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল। তাদের উদ্দেশেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সবার তথ্য আমার কাছে আসছে। আমি কাউকে ছাড়ব না। দল করতে হলে কে কোথায় কী করছে সে খোঁজখবর শীর্ষ নেতৃত্বকে নিতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শুধু পাপিয়া নয়, অপকর্ম, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের সঙ্গে যারাই জড়িত তারা নজরদারিতে আছে। পাপিয়াদের পেছনে যারা আছেন, তারাও নজরদারির বাইরে নন। টার্গেট পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

এমপি হতে চেয়েছিলেন পাপিয়া : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে প্রভাবশালীদের পেছনে পাপিয়া খরচ করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। শুধু তা-ই নয়, টাকার সঙ্গে অনেকের ডেরায় পাঠিয়েছেন সুন্দরী নারী। তাদের চাহিদা অনুযায়ী মাঝেমধ্যেই উড়িয়ে এনেছেন থাই, নেপালি, ভারতীয়, ভুটানি ও রাশিয়ান সুন্দরীদের। সংসদীয় আসনের মনোনয়ন না পেলেও সর্বশেষ সংরক্ষিত মহিলা আসনের জন্য তিনি দলের যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীর মাধ্যমে ৩ কোটি টাকা দিয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া এবং তার স্বামী মতি সুমনের এমন তথ্যে বিব্রত তদন্ত-সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা। তবে এর আগে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ বাগাতে তিনি খরচ করেছিলেন ২ কোটি টাকা। রিমান্ডে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে পাপিয়া জানিয়েছেন, যুব মহিলা লীগের নেত্রী এবং এমপি মনোনয়নের জন্য সব মিলিয়ে অন্তত ১০ কোটি টাকা খরচ করেছেন তিনি। তবে মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। নাম দেন কিউ অ্যান্ড সি। কিউ অ্যান্ড সির সদস্যরা মাদক ব্যবসা, চাঁদা তোলা, মাসোহারা আদায়, তুলে এনে টাকা আদায়, অনৈতিক কাজ করানো এবং জমি দখলের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা পাপিয়ার হাতে তুলে দিতেন। গোয়েন্দা পুলিশ তিন দিন ধরে পাপিয়া ও তার স্বামী মতি সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কখনো এককভাবে, আবার কখনো দুজনকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের দুই সহযোগী সাব্বির ও তায়্যিবাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন গোয়েন্দারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘আসলে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। তবে তাদের দেওয়া সব তথ্যই আমাদের যাচাই-বাছাই করতে হচ্ছে। এর আগে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’

সর্বশেষ খবর