সোমবার, ২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মামলার জালে ৪১ হাজার কোটি টাকা

আদালতে ২৭ হাজার ৭২৫ রাজস্ব ফাঁকি মামলা, কাস্টমস-বন্ডের পাঁচ হাজার ৬৩৭ কোটি, মূসক সংক্রান্ত ২২ হাজার ৮৫০ কোটি, আয়করের ১২ হাজার ৯১৭ কোটি

আরাফাত মুন্না

মামলার জালে ৪১ হাজার কোটি টাকা

উচ্চ আদালত ও রাজস্ব-সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালগুলোতে ঝুলে আছে ২৭ হাজারেরও বেশি রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা। কাস্টমস, বন্ড, মূসক ও আয়করের এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ৪১ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিচার বিভাগের চলমান দীর্ঘসূত্রতাকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রেখেছে স্বার্থান্বেষী মহল। তারা মামলাকে রাজস্ব আটকানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

আইনজ্ঞরা বলেন, রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা বেশি দিন ঝুলে থাকা মানে সরকারের কোষাগারের ওপর ধারাবাহিকভাবে চাপ সৃষ্টি হওয়া। যার ভোগান্তি জনগণকেই ভুগতে হয়। তারা বলেন, বর্তমানে রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য হাই কোর্টে একাধিক বেঞ্চ নির্ধারিত থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বেঞ্চ বৃদ্ধির পাশাপাশি এসব মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বলেও তাদের মত। এনবিআর থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে রাজস্ব-সংক্রান্ত ২৭ হাজার ৭২৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে সরকারের রাজস্ব জড়িত ৪১ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে রিট, আপিল ও ট্রাইব্যুনালে অন্যান্য ১৮ হাজার ৭০টি কাস্টমস ও বন্ড-সংক্রান্ত মামলায় ৫ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা আটকে আছে। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) সংশ্লিষ্ট ২২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা আটকে আছে ৯ হাজার ৩০৫টি মামলায়। এ ছাড়া আয়কর-সংক্রান্ত ৩৫০টি মামলায় ১২ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় আটকে রয়েছে।

জানা গেছে, রাজস্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে করদাতা কিংবা ব্যবসায়ীরা চাইলে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। বিভিন্ন সময় এমন বিরোধে করদাতারা আদালতে গিয়েছেন। তবে সম্প্রতি এ প্রবণতা বেড়েছে। যে হারে রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে, নিষ্পত্তির হার সে তুলনায় ধীরগতিতে হওয়ায় দিন দিন মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। ভ্যাট-ট্যাক্স সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে যেমন ব্যবসায়ীরা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন, একইভাবে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীরাও আদালতে মামলা করে আটকে রাখছেন হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।

জানতে চাইলে এনবিআরের আইন কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অমীমাংসিত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় হবে। এ বিষয়ে এনবিআর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য এনবিআরের আলাদা লিগ্যাল উইং নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ই এসব মামলা পরিচালনা করে। এনবিআরের পক্ষ থেকে সব সময়ই অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে তাগিদ দেওয়া হয় বলেও জানান তিনি। জানতে চাইলে উচ্চ আদালতে রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনাকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেক সময়ই আবেদনকারী পক্ষ মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতায় ফেলার চেষ্টা করে। তবে আমরা তৎপর থাকায় এখন সে সুযোগ তারা খুব একটা পায় না।’ তিনি বলেন, বর্তমানে হাই কোর্টে তিনটি পৃথক বেঞ্চে রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুতই রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলার জট নিরসন করা সম্ভব হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ভ্যাট বা ট্যাক্স দাবি করলে এর বিরোধিতায় আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন বা উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা যায়। উচ্চ আদালত রিট দায়ের করার পর আবেদন খারিজ করে এনবিআরে পাঠাতে পারে। সে ক্ষেত্রে এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হয়। এ জন্য দাবিকৃত অর্থের ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনীয় শুনানি শেষে রায় দেয়। এরপর বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ফের উচ্চ আদালতে আপিল করে। এভাবে গড়িয়ে যায় বছরের পর বছর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাজটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী মামলাকে রাজস্ব ফাঁকির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। যেহেতু সরকার এখানে ক্ষতিগ্রস্ত, তাই সরকারকেই এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এনবিআরের উচিত হবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে এ-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। জানতে চাইলে হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস যদি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। তিনি বলেন, অনেক সময়ই দেখা যায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে রুলের জবাব পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে মূল রুল শুনানি বিলম্বিত হয়ে যায়। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আলতাফ হোসেন বলেন, অনেক সময় দেখা যায় রাজস্ব কর্মকর্তাদের অনেক ত্রুটি থাকে। এনবিআরসহ রাজস্ব-সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করেন সাবেক এই বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর