মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা

শাজাহান সিরাজ

স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষ। আমি, কাজী আরেফ, মার্শাল মণি, স্বপন চৌধুরী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শিবনারায়ণ দাস, কামরুল আলম খান খসরুসহ কয়েকজন ব্যস্ত। উদ্দেশ্য পতাকা তৈরি করা। লাল রং ছিল আমার বরাবরই পছন্দের। এটা সবাই জানত। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আ স ম আবদুর রব ভাইসহ আমার বন্ধুরা সবাই জানতেন, লাল আমার ভীষণ পছন্দ। তাই লাল রঙের বৃত্ত রাখার প্রস্তাবটি সবাই গ্রহণ করলেন। কেউ কেউ বললেন, বাংলাদেশ   যেহেতু সবুজের সমারোহ, তাই লাল আর সবুজের পতাকা হওয়া উচিত। তবে আমি সবুজের ঘোর বিরোধিতা করি। কারণ, সবুজ ছিল পাকিস্তানের পতাকার অংশবিশেষ। তাদের আদলে কোনো কিছুই করার পক্ষে ছিলাম না। মার্শাল মণি বললেন, গাঢ় সবুজ থাকতে হবে। কারণ, এটা বাংলাদেশেরই চিত্র। একপর্যায়ে সবাই তা গ্রহণ করলেন। এরপর কাজী আরেফ বললেন, গাঢ় সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্তের ভিতরে বাংলাদেশের মানচিত্র থাকতে হবে। এ নিয়ে নানা ধরনের কথা হলেও একপর্যায়ে তাও গ্রহণ করা হলো। এই হলো জাতীয় পতাকার ইতিহাস। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল গোটাবিশেক পতাকা তৈরি করা। এ জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় শিবনারায়ণ দাসকে। মূলত তিনিই পতাকা তৈরির কাজটি করেন। আমরা ২০টির মতো পতাকা বানিয়েছিলাম। আশ্চর্যের বিষয়- আমাদের বানানো পতাকা দেখে লাখ লাখ পতাকা তৈরি হলো। ঢাকায় সেগুলো দেদার বিক্রি হলো। পতাকার প্রতি মানুষের কত যে আবেগ, কত টান তা সেদিন দেখতে  পেয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টারি পার্টির  নেতাদের ৩ মার্চ ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে বসার আহ্বান জানালেন। এতে আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, ন্যাপ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও পিডিপির নেতাদের আসতে বলা হয়। বঙ্গবন্ধু এই বৈঠককে ‘নিষ্ঠুর তামাশা’ বলে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। ওইদিন বিকালে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক বিশাল ছাত্র-জনসভা হলো। এ সভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানসহ অনেকেই বক্তৃতা করেন। সেখানে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পড়ি। ইশতেহার পড়েছি দুইবার। একবার পড়ি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে। দ্বিতীয়বার পড়ি বঙ্গবন্ধুর সামনে। এই ইশতেহার পাঠ দেশের ইতিহাসে আর আমার জীবনে সবচেয়ে বড় একটি ঘটনা। সভায় বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করার কথা আমার। পল্টন ময়দানে তখন লাখো মানুষের ঢল। মানুষ পাগলের মতো বার বার বলছিল, ‘পড়ুন, এখনই ইশতেহার পড়া শুরু করুন।’ অনেকটা বাধ্য হয়েই পড়তে শুরু করলাম। ইশতেহার পড়ার শেষ মুহূর্তে মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ইশতেহার পড়া শেষ করে ফেললাম; বঙ্গবন্ধুর সামনে আবার পড়া শুরু করলাম। লাইনের পর লাইন পড়ে গেলাম। ইশতেহারের ঘোষণায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ৭ কোটি মানুষের আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ বলে উল্লেখ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করি। ইশতেহারে জাতীয় পতাকা  কেমন হবে তার উল্লেখ ছিল। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু হবেন স্বাধীন বাংলার মহান নেতা।’ বঙ্গবন্ধু সবসময় গুনগুন করে গাইতেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাই আমরা এই গানটি বেশি পছন্দ করতাম। তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে প্রস্তাবগুলো গৃহীত হলো। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পল্টন ও আশপাশের এলাকা। সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন শুরুর ডাক দেন। তিনি অবিলম্বে  সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের জন্য সামরিক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। লেখক : স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক।

সর্বশেষ খবর