বুধবার, ৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

সেদিনের ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ নেই

নূরে আলম সিদ্দিকী

সেদিনের ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ নেই

মার্চ এলেই তথাকথিত একশ্রেণির রাজনীতিক নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেমালুম চালিয়ে দিতে চান। অথচ তাদের সত্যিকার পরিচয় হলো, তারা সুবিধাবাদী। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লালসায় যারা ৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে একটি তথাকথিত এবং স্বকল্প-কল্পিত সশস্ত্র বিপ্লবের দুঃস্বপ্নে বুঁদ হয়ে ৭০-এর নির্বাচন-পূর্বকালে স্লোগান দিতেন- ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, পূর্ববাংলা স্বাধীন কর’- এই সমস্ত তথাকথিত অতিবিপ্লবীরা বিপ্লবের রোমান্টিসিজমে এতটাই বিভোর ছিলেন যে, গণতন্ত্র-নির্ভর আমাদের রাজনীতি তো বটেই, সুযোগ ও সময় পেলে তারা বঙ্গবন্ধুর মননশীলতারও অনাকাক্সিক্ষত বিরোধিতা করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক চরিত্রকে বিকৃত করে তুলে ধরার বিভ্রান্তিকর অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত হতেন। অথচ বঙ্গবন্ধু শুধু ছাত্রলীগের আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, আন্দোলনের সমগ্র পথপরিক্রমণে তিনি ছিলেন মূর্ত প্রতীক- চেতনা ও বিশ্বাসের আধার। মূল কথাটি হলো, শাসনতান্ত্রিক রাজনীতির মুখপাত্র হিসেবে যে কথাটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হতো না, সমীচীনও ছিল না, সেই কথাটি তাঁরই পরামর্শে এবং নির্দেশনায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো অকুতোভয় ছাত্রলীগের নির্ভীক কণ্ঠে। এইসব অতিবিপ্লবীরা দেশ স্বাধীনের পরপর স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি, অর্থাৎ- মুসলিম লীগ, জামায়াতের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে চলেছে। জামায়াতের রাজনীতি যখন নিষিদ্ধ ছিল, তখন জামায়াত ও মুসলিম লীগের তরফ থেকে অঢেল আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হতো তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিকে টালমাটাল ও বিপথগামী করার জন্য- বঙ্গবন্ধুর সরকার ও প্রশাসনকে একটা প্রচ- অস্থিরতার মুখোমুুখি দাঁড় করানোর জন্য।

আন্ডারগ্রাউন্ড অস্ত্রধারীরা থানা লুট, খাদ্যগুদামে আগুন, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জনাব কিবরিয়াকে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। উন্মত্ত পাশবিকতা প্রদর্শন, সামাজিক ও প্রশাসনিক সে অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা তারা আনতে চেয়েছিল এবং তাতে কিছুটা হলেও তারা সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তাতে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তিরই মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। ৭০-এর মতো ৭৪-এর মন্বন্তরকে অবশ্যম্ভাবী করতে সাহায্য করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয়কে ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত করেছে। এইসব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপকর্মে নাটের গুরু ও নেপথ্যের খলনায়ক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তবুও আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, বঙ্গবন্ধুকে তিনি কখনোই প্রকাশ্যে গালিগালাজ করা তো দূরে থাক, কখনো বিরোধিতাও করেননি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসা দখল করে নেওয়ার অলীক ও উদ্ভট প্রচেষ্টাকালীন যখন সরকার ও জাসদের মধ্যে প্রচ- গোলাগুলি হচ্ছিল, তখনো সিরাজুল আলম খান অবোধ শিশুর সরলতা প্রদর্শন করে বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন যে, ‘এটি জলিল-রবের হঠকারিতা। সরকার জাসদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে ওদের ঔদ্ধত্য অবদমিত হবে।’

আমাদের যেমন লক্ষ্য ছিল- বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা; সেক্ষেত্রে জাসদপন্থিরা নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের প্রতি আদৌ অবিচল ছিল না। সেই তাদের মুখে যখন আজকে অলীক ও অদৃশ্য নিউক্লিয়াস তত্ত্ব শুনি, তখন এই নির্জলা মিথ্যাচারে বিস্ময়াভিভূত হই। তারা কি বলতে চান, বঙ্গবন্ধুর বিকল্প নেতৃত্ব নিউক্লিয়াসের (তাদের দাবি অনুযায়ী) মাধ্যমেই তারা দেশ স্বাধীন করার দুঃস্বপ্ন দেখতেন? তাদের দাবি অনুযায়ী নিউক্লিয়াসের দুই নম্বর নেতা কাজী আরেফ। কাজী আরেফ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ৬২ সালে যখন নিউক্লিয়াস গঠিত হয় বলে তারা দাবি করেন, তিনি তখন মেট্রিক পাস করে কেবল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এটি কল্পনা-বিলাসিতার একটা সীমাহীন পরিহাস। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ স্বাধীনতার সপক্ষের সব শক্তিরই এই হীনমন্যতা ও অর্বাচীনতার প্রতিবাদ করা উচিত। নইলে হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস যে বলেছিলেন- একটি মিথ্যা প্রতিবাদহীনতার সুযোগে বারবার উচ্চারণে সত্যে রূপান্তরিত হয়, এক্ষেত্রেও তাই হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণে-অকারণে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবদানকে খাটো করে নানা প্রচার অলীক উদভ্রান্ত ও কল্পনা-প্রসূত তথ্য-উপাত্ত হাজির করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হবে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, টুকরো-টুকরো হওয়া জাসদের কথা মানুষ শুনেও না, পাত্তাও দেয় না। কিন্তু যারা সত্যের সারথি, যারা মুক্তিযুদ্ধের নিয়ামক শক্তি, বঙ্গবন্ধুর অবমূল্যায়নে প্রতিবাদ করা তাদের নৈতিক দায়িত্বের আবর্তে এসে যায়। ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে উল্লেখ করতে হয়, কল্পনা-বিলাসী রোমান্টিক বিপ্লবীদের অপপ্রয়াসের ও ভ্রান্তিবিলাসের ওই মারাত্মক মরণখেলাকে আমরা রুখে দিতে পেরেছিলাম। তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি ছিলাম আমি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাজাহান সিরাজ। বিনম্রচিত্ত ও শালীন মানসিকতার শাজাহান সিরাজ তো বটেই, কোনো জনসভাতে আমার উপস্থিতিতে জনাব আ স ম আবদুর রব বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করার দুঃসাহস দেখাতে পারেননি। কারণ, পল্টনের জাগ্রত জনতা ওই ধরনের অপচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করত। ওদের রাজনীতি যে কতটা অন্তঃসারশূন্য তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জাসদ আজ সত্যিকার অর্থে মানিপ্লান্টের মতো অন্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। কখনো বিএনপি, কখনো জাতীয় পার্টি, কখনো আওয়ামী লীগ- সবার সঙ্গেই তারা সংসার পেতেছেন। আবার ক্ষণিকের সেই সংসার ভেঙেও গেছে। এই তো সেদিন, আ স ম আবদুর রব সাহেব শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তবে একটা গাড়ি, একটা পতাকা ও একটা বাড়ি ছাড়া শেখ হাসিনা তাকে আর কিছুই দেননি। অর্ধমৃত, রাজনীতিতে নীরব, নিথর, নিস্পৃহ বিএনপির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রব সাহেব কোন স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যাপৃত হয়েছেন আমি বুঝি না।

সর্বশেষ খবর