শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ভোরে উঠেই ছুটতাম হরতাল করতে

শরীফ নুরুল আম্বিয়া

ভোরে উঠেই ছুটতাম হরতাল করতে

১৯৭১ সালের পুরো মার্চ মাসটিই ছিল উত্তাল। ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন বসার কথা। এর দুই দিন আগে ১ তারিখে হঠাৎ করেই অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন ইয়াহিয়া খান। কারও বুঝতে বাকি থাকল না পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য। তারা ক্ষমতা দিতে চাইছে না। ছাত্র-যুবসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। ওইদিনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশাল জনসমাবেশ হলো পল্টনে। ঘোষণা এলো হরতালের। ২ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন হলো। ৩ তারিখে ঘোষণা হলো স্বাধীনতার ইশতেহার। পরদিন ৪ মার্চের হরতালে জনগণ অভাবনীয় সাড়া দেয়। দেশের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ইশতেহারে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন হবে, রাজনীতি কেমন হবে, পতাকা কেমন হবে, জাতীয় সংগীত কী হবে, যুদ্ধের নেতৃত্ব কে দেবে- এমন অনেক বিষয়ে স্পষ্ট আউটলাইন দেওয়া হয়। ১ তারিখের পর ৬ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোরে উঠেই ছুটতাম হরতাল করতে। সবকিছু বন্ধ করে দিই আমরা। সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকায় তখন রিকশাও ছিল হরতালের আওতায়। ৪ মার্চ নাগাদ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আদালত, শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাস, রেল, স্টিমার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ।

আমাদের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল। আবার সংশয়ও ছিল- আমরা চাইলেই কি পাকিস্তান আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেবে? পেতে হলে অর্জন করতে হবে। সে জন্য যুদ্ধ করতে হবে। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের প্রশ্নে যে সমস্ত উপাদান দরকার ছিল সেগুলো ঊনসত্তরের আন্দোলন থেকেই প্রধানত আমরা অর্জন করেছি। একজন নেতা দরকার ছিল যিনি দায়িত্ব নেবেন। নিউক্লিয়াসের নেতারা বঙ্গবন্ধুর ওপরে সেই আস্থা রেখেছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন, সত্তরের নির্বাচনে ম্যান্ডেটের পর সেটা আরও সুসংহত হয়। যখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়া হলো তখন মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজেছে। তারা পূর্বাণীতে গেছে, যেখানে বঙ্গবন্ধু মিটিং করছিলেন। ১ মার্চের পর ছাত্রদের মধ্যে বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে যে কলাকৌশলগত বিভেদ ছিল তা মিলে গেল। মার্চ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন। সংগঠনটি ঘোষণা দিল, এরপর আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় এলে সংগ্রাম আরও জোরেশোরে শুরু হলো। ১৮ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশ ছিল মিছিলে মিছিলে উত্তাল। ২৩ মার্চ ছিল ‘পাকিস্তান দিবস’। প্রথা অনুযায়ী ওইদিন সারা দেশে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ার কথা। সেদিন পল্টন ময়দানে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হলো। জয় বাংলা বাহিনী বঙ্গবন্ধুর ভবনে গিয়ে পতাকা তুলে দিল। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সারা দেশে সেদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ওঠে। মুক্তি সংগ্রামে সাংগঠনিক শক্তি দিয়েছে নিউক্লিয়াস যার অন্যতম একজন ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি পুরো ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ছিলেন সেতুবন্ধ। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিল অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক এবং তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিরই অংশ। নিউক্লিয়াসের মধ্যে দিয়ে গঠিত হয় মুক্তি বাহিনী, মুজিব বাহিনী। পুরো জনগণকে একত্রিত করার সুবিধার্থে নামকরণ হয় মুজিব বাহিনী। লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর