শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আতঙ্কে দাপুটে নেতারা

রাতারাতি অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক বনা নেতা ও গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, চলবে অভিযান

মির্জা মেহেদী তমাল ও রফিকুল ইসলাম রনি

আতঙ্কে দাপুটে নেতারা

সরকারি জমি দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও অবৈধ উপায়ে অর্থসম্পদের মালিক বনে যাওয়া দাপুটে নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা এখন আতঙ্কে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপক তৎপরতায় এ আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সরকারি সূত্রমতে, অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির কারণে রাতারাতি অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার দিন শেষ। দুর্নীতি, অপকর্মের গডফাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এ অভিযান সারা দেশে আরও জোরদার হবে। জেলা-উপজেলায় ইতিমধ্যে দুর্নীতি, টেন্ডার-চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তালিকা ধরে ধরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্রমতে, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সুশাসনে নজর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দখল করে রাখা সরকারি জায়গা উদ্ধার করা হচ্ছে। গত তিন দিন ঢাকার কেরানীগঞ্জের চরওয়াশপুরে বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে গড়ে তোলা মায়িশা পাওয়ার প্লান্টে অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। বুধবার দলবল নিয়ে এসেও অভিযান বন্ধ করতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ঢাকা-১৪ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি আসলামুল হক। এর আগেও ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমের দখলে থাকা বুড়িগঙ্গার জায়গা দখলমুক্ত করা হয়। শুধু আসলামুল হক আসলাম ও হাজী সেলিমই নন, সারা দেশেই এমন দখলদার এমপি-মন্ত্রী ও নেতা রয়েছেন। তাদের দখলে থাকা সরকারি জায়গা উদ্ধারসহ হঠাৎ কোটিপতি হওয়া নেতাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন সংস্থা এ তালিকা করছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব উইং থেকেও পৃথক তালিকা করা হচ্ছে। ক্রস চেক করে তালিকায় থাকা অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে এখন অ্যাকশন শুরু হবে। দখলবাজ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রাখায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ অভিযান অব্যাহত থাকুক। কোনো অপশক্তির চাপে যেন এটা বন্ধ না হয়। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দখলবাজ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন ঘোষণা দিয়ে করার দরকার নেই। এটা মশক নিধন কিংবা ট্রাফিক সপ্তাহ নয় যে, আগে দিনক্ষণ ঠিক করে করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই এমপি-মন্ত্রীদের হুঁশিয়ার করেছিলেন অপকর্মকারী যত প্রভাবশালীই হোক, কাউকে ছাড়বেন না। তাঁর এ ঘোষণার প্রতিফলন আমরা গত পরশু দেখেছি দলীয় সংসদ সদস্য আসলামের দখলে থাকা জায়গা উদ্ধারের মধ্য দিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এ অ্যাকশন অব্যাহত থাকুক। তবে ঘোষণা দিয়ে নয়। কোনোভাবেই যেন এটা গতিহারা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে দুর্বৃত্তায়ন ও অপকর্ম কমে আসবে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ‘সরকার যে কাজটি করছে তা নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকে করছে। দেশের মানুষের সম্পদ সুরক্ষিত রাখতে দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তা করতে না পারলে এটা রোধ করা যাবে না। ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে জনগণের সমর্থন রয়েছে। স্বাগত জানাচ্ছে তারা। আর এ কারণেই এখান থেকে পিছু হটা যাবে না।’ প্রথমে চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হয় পদ থেকে। এরপর ক্যাসিনোকান্ডে গ্রেফতার করা ঢাকা মহানগরী যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, ক্যাসিনো খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম, এনু-রুপনসহ কয়েকজনকে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ তারকা হোটেলে পতিতাবৃত্তি এবং মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া। একের পর এক দলের ভিতরে শুদ্ধি অভিযান ও গ্রেফতার শুরু হওয়ার পর আতঙ্কে রয়েছেন দাপুটে নেতারা। যারা এত দিন সরকার জমি দখল, টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি বাণিজ্যসহ অবৈধ উপায়ে অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। হঠাৎ বিত্তশালী হওয়া নেতা-এমপি-মন্ত্রীরাও আতঙ্কে ভুগছেন। দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজরাও ভয়ে রয়েছেন। দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি কাউকেই ছাড় দেবেন না। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সুশাসন নিশ্চিত করাই তাঁর লক্ষ্য। সরকারের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্র এমন তথ্য জানিয়েছেন। একাধিক সূত্র জানান, অবৈধ পথে হঠাৎ কোটিপতি হওয়া নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের তালিকা হচ্ছে। এ তালিকা ধরেই এখন অভিযান চলবে। শুধু আওয়ামী লীগ নেতাই নন, সহযোগী সংগঠনের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ আমলা ও তাদের আত্মীয়স্বজনরাও নজরদারিতে রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত ১১ বছরে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিও দখল বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে অবৈধ টাকা কামিয়েছেন। তাদেরও তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসূত্র জানিয়েছেন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো আওয়ামী লীগ নেতা-এমপি-মন্ত্রী কিংবা সহযোগী সংগঠনের নেতাই নন, এ তালিকায় তাদের পিএস, এপিএসসহ নিকটাত্মীয়রাও রয়েছেন। সূত্রে আরও জানা যায়, দুর্নীতিবাজ নেতাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুদকের ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে ২২ জন সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের নিজস্ব গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে গত মঙ্গলবার তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব গোয়েন্দা কর্মকর্তা সঠিকভাবে দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ ও তালিকা তৈরির কাজটি করবেন। তাদের কার্যক্রম নিবিড় নজরদারি করার জন্য পরিচালক পদমর্যাদার আরও আটজন কর্মকর্তাকে শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দুদকের একজন পরিচালক জানান, এসব গোয়েন্দা কর্মকর্তা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এমন কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করে নিয়মিত প্রধান কার্যালয়ে পাঠাবেন। দুদকের কাছে এরই মধ্যে যেসব তথ্য-উপাত্ত এসেছে, সেই তথ্যের সঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে। সন্ত্রাস, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি-স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি, ক্ষমতার অপব্যবহার-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনৈতিকতার মাধ্যমে যে বা যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করছেন, তাদের বিরুদ্ধেই গোপন অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। গত বছর সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত ২ শতাধিক ব্যক্তি তালিকাভুক্ত হয়েছেন। দুদকের দায়ের করা ২৯ মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাট, খালেদ, জি কে শামীমসহ অন্তত ৬১ জন। অন্যদিকে চাঁদাবাজি, মানি লন্ডারিং, দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধে ক্যাসিনো তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে সিআইডির পক্ষ থেকেও প্রায় ৫০টি মামলা করা হয়েছে। অনেক মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেওয়া হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর