শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

হালকা শিল্পে অভাবনীয় বিপ্লব

দেশীয় প্রযুক্তির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন, উৎপাদন ও বাজারজাতের মাধ্যমে তারা বদলে দিয়েছেন দৃশ্যপট, চীন-ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্ব বাজারে ঠাঁই করে নিচ্ছে

সাঈদুর রহমান রিমন

হালকা শিল্পে অভাবনীয় বিপ্লব

দেশের হালকা শিল্পে গত এক যুগে অভাবনীয় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখছেন। দেশীয় প্রযুক্তির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন, উৎপাদন ও বাজারজাতের মাধ্যমে তারা বদলে দিয়েছেন দৃশ্যপট। কদিন আগেও অতিপ্রয়োজনীয় যেসব যন্ত্রপাতি-মেশিনারিজ শতভাগ আমদানিনির্ভর ছিল, আজ নিজেরাই সেসব তৈরি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করছেন। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত মেশিনারিজ এখন চীন-ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বিশ্ব বাজারে ঠাঁই করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে কার্যকর সরকারি নীতি সহায়তা পেলে হালকা ও মাঝারি শিল্প খাতে সফলতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পে ব্যতিক্রম সাফল্যের মুকুট নিয়ে কয়েক যুগ ধরেই দৃষ্টান্ত হয়ে আছে জিঞ্জিরা। এখানকার ঝুপড়ি বস্তির অজস্র কারখানায় খুদে ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি করা হাজারো পণ্যসামগ্রীর কদর রয়েছে সর্বত্র। দেশ-বিদেশে ‘মেইড ইন জিঞ্জিরা’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতিও আছে। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই জিঞ্জিরা শিল্পের বিস্তার। অনর্গল ইঞ্জিনের ধস ধস, গড় গড় শব্দ, কারিগরের সদাব্যস্ত হাঁকাহাঁকি, শ্রমিকদের কোলাহল-আওয়াজ; সেখানকার রাত দিনের ব্যবধান পর্যন্ত ঘুচিয়ে দিয়েছে। গোটা এলাকায় চলছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। জিঞ্জিরাতেই গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্প কারখানা। ৬ লাখ কারিগর-শ্রমিকের উদয়াস্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠছে সম্ভাবনার আরেক বাংলাদেশ। স্থানীয় যন্ত্রাংশের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও ক্ষুদ্র ও হালকা এ শিল্পে সরকারিভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সহযোগিতা নেই বললেই চলে। ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে নিচ্ছেন সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে। জাহাজ ভাঙা স্ক্র্যাপ, বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, রোলিং মিল, নির্মাণাধীন স্থাপনার পরিত্যক্ত লোহা ও শিট সংগ্রহ করে সেগুলো থেকেই তাক লাগানো নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন হাতুড়ে কারিগররা। ব্যাপকসংখ্যক হালকা এ ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য বিশ্ববাজারে সীমিত পরিমাণে ঠাঁই করে নিচ্ছে। সুঁই, ব্লেড, আলপিন থেকে শুরু করে নাটবল্টু, রেল-বিমানের যন্ত্রাংশ, ফ্লাস্ক, মোবাইল ফোনসেট থেকে শুরু করে সমুদ্রগামী জাহাজের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে এখানে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মালামাল তৈরি করছেন লেখাপড়া না জানা ‘ইঞ্জিনিয়ার’রা। কথিত আছে বছরের পর বছর গবেষণা শেষে জাপান, কোরিয়া, চীন যেসব সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করে- সেসব জিনিস একনজর পরখ করেই হুবহু তৈরি হতে থাকে জিঞ্জিরায়। সেখানকার অভাবনীয় মেধার খুদে কারিগরদের দক্ষতা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। উদ্যোক্তারা জানান, সরকারি অনুমোদন, পুঁজি ও নীতি সহায়তা পেলে জিঞ্জিরার কারিগররা অত্যাধুনিক ড্রোন-রোবটও প্রস্তুত করে দিতে পারবেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জিঞ্জিরাকে অনুসরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই ধরনের প্রায় ৫০ হাজার শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ১২ লাখ কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্র জানায়, হালকা প্রকৌশল শিল্পে প্রায় ৪ হাজার যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩৭টি আইটেম দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৭টি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। বর্তমানে বার্ষিক ৪৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের এ খাত থেকে সরকার কমবেশি তিনশ কোটি টাকা রাজস্ব পায় বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হালকা প্রকৌশল পণ্যকে ২০২০ সালের ‘বর্ষ পণ্য’ ঘোষণা করায় সরকারিভাবেই শিল্প খাতটি বিশেষ গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের অধীনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হব।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোমোবাইল, অটোপার্টস, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি, সোলার ফটো-ভল্টিং মডিউল, বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীসহ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বাংলাদেশ আরও পণ্য উৎপাদন করতে পারে এবং এর বিশাল বাজারও আছে।

‘জিঞ্জিরা শিল্প’র বিস্তার ঘটছে : শিল্পকারখানার মালিকরা জানান, গত দুই দশকে ‘জিঞ্জিরা শিল্প’ অগ্রসর হয়েছে অনেক দূর। এখন আর তা জিঞ্জিরা-কেরানীগঞ্জেই সীমাবদ্ধ নেই, সম্প্রসারিত হয়েছে রাজধানীর আনাচে-কানাচেসহ দেশজুড়ে। রাজধানীর মীরহাজিরবাগ, মাতুয়াইল, ডেমরা, চকবাজার-লালবাগ, ইসলামবাগসহ মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে জিঞ্জিরা শিল্পের আদলে অসংখ্য খুদে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। বসতবাড়ির ২/১টি কক্ষ ব্যবহার করেই উৎপাদনমুখী নানা কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকছেন খুদে উদ্যোক্তারা। যার তেমন একটা পুঁজি নেই সে নিদেনপক্ষে একটা বোতাম কারখানা দিয়ে বসেছে, না হয় বসতঘরেই ফ্যানের কয়েল বাঁধার কাজে জড়িয়ে থাকছেন। শুধু ঢাকাতেই নয়, জিঞ্জিরা মডেল অনুসরণ করে ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, চট্টগ্রাম, যশোর নওয়াপাড়া, টঙ্গী-গাজীপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খুদে ও মাঝারি শিল্প ইউনিট। সেসব কারখানায় শুধু পণ্যই উৎপাদিত হচ্ছে না, পণ্য উৎপাদনকারী মেশিনারিজও বানিয়ে তা নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে।

কৃষি যন্ত্রাংশ প্রস্তুতে নীরব বিপ্লব : উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। বিসিক শিল্পনগরীসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কয়েকশ কল-কারখানা। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এসব কল-কারখানায় প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি উৎপাদন হলেও কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি সাশ্রয় হচ্ছে। স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা মেটানো এসব কৃষি যন্ত্রপাতি প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশেও ব্যাপক চাহিদার ভিত্তিতে রপ্তানি হচ্ছে। এসব কারখানায় তৈরি যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে পানির পাম্প, টিউবওয়েল, শ্যালো ইঞ্জিনের লায়নার, পিস্টন, পাওয়ার টিলার, ধান ও ভুট্টা মাড়াই মেশিনসহ সব কৃষি উপকরণাদি। এ ছাড়াও প্লানার, ক্রাংক শ্যাফট গ্রানডিং, মিলিং, সেপার, বোরিং মেশিন, লেদ মেশিন, স’ মেশিন ইত্যাদি তৈরি হয়। ভাঙা জাহাজের লোহা-লক্করসহ পরিত্যক্ত লোহা ব্যবহার করেই দিন-রাত তৈরি হচ্ছে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বগুড়ায় তৈরি কৃষি সরঞ্জামাদির মধ্যে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, লাইনার, পিস্টনসহ ডিজেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ গাড়ির ছোট-বড় যন্ত্রাংশ, সাইকেল-রিকশার পার্টসসহ নানারকম মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ সারা দেশে ব্যাপক চাহিদার বাজার সৃষ্টি করেছে। এসবের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে শিশুপার্কের বিভিন্ন রাইডস। কর্মসংস্থান হয়েছে এক লাখেরও বেশি মানুষের।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর