শুক্রবার, ৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
অর্থনীতি সম্মেলন

সরকার সারা জীবন সুদ হার বেঁধে দেবে না : অর্থমন্ত্রী

করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে -রেহমান সোবহান
কর সংগ্রহে আমাদের ঘাটতি আছে -সালমান এফ রহমান
রাজনৈতিক চাপে অনেক সময় ঋণ -মির্জ্জা আজিজ
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ছড়াছড়ি -হোসেন জিল্লুর
বিনিয়োগের উপকরণ সহজলভ্য করুন -সালেহ উদ্দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার সরকার সব সময় নির্ধারণ করে দেবে না। বাজার স্থিতিশীল হলে সুদের হারও স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি হোটেলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সম্মেলন শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। দৈনিক বণিকবার্তা ও সিটি ব্যাংকের আয়োজনে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বণিকবার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি শিল্পায়ন। আমরা শিল্পায়ন করার জন্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। শিল্পায়ন প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুদের হার বেশি হলে শিল্পায়ন হবে না। ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ যদি সুদের হার হয়, কোনো উদ্যোক্তা তা শোধ করতে পারবেন না। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কেন বাড়বে না? ঋণের সুদহার যদি এত বেশি হয় তাহলে খেলাপি তো হবেই। সুদের হার বেশি এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হার নির্ধারণের কারণে দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ফলে শিল্পায়নের সম্প্রসারণ হচ্ছে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। তাই এখানে হাত দেওয়া হয়েছে। কারণ যে দেশে সুদহার বেশি সে দেশে বিনিয়োগ কম হয়। সে জন্য আমরা সারা জীবন সুদের হার বেঁধে দেব না। পরিস্থিতির উন্নতি হলে অবশ্যই এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘একসময় ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। বঙ্গবন্ধুর আগমনে আমরা সৌভাগ্যবান যে তিনি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন। মানুষকে বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। নানা সংকট আমাদের রয়েছে। বঙ্গবন্ধু গরিব মানুষের জন্য সেভিংস স্কিম করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, ধনীরা এর সুফল নিচ্ছে। এখন আমরা ব্যাংকের সেভিংস স্কিম পুরোপুরি অটোমেশন করেছি। পোস্টাল সেভিংস স্কিম অটোমেশন করা হচ্ছে। এতে প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবে। কারণ সেভিংস স্কিমে সেলিং করে দেওয়া হয়েছে। সেভিংস স্কিমে সুদের হার কমানো হয়নি। বরং আরও বাড়ানো হবে। পোস্টাল সঞ্চয়পত্র অটোমেশনে আনার পর ঠিক করা হবে, এখানে কেউ ঠকবেন না।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের তুলনা করা হয়। ভিয়েতনামে সুদের হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। আমি বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি কি না অনেকে প্রশ্ন তোলেন। অবশ্যই আমি বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি। যুক্তরাষ্ট্রও সুদের হার কমিয়ে-বাড়িয়ে দেয়। আমরাও দিয়েছি। শিল্পায়নের জন্য আমাদের কিছু ছাড় দিতেই হবে।’ মুস্তফা কামাল বলেন, ‘কেউ কেউ বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এটা কোনো যৌক্তিক কথা নয়। কর্মসংস্থান না হলে প্রবৃদ্ধি হয় না। দুটো হাত ধরাধরি করে চলে। সারা দেশে বড় বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হয়েছে। এখানে দুই থেকে তিন কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। এসব অঞ্চলে শিল্পায়নের জন্য যে ধরনের নীতিসহায়তা, ছাড় দেওয়া প্রয়োজন, আমরা সেটা দিয়েছি।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কর প্রবৃদ্ধি আমাদের কম- ৯ থেকে ১০ শতাংশ। এটাও ঠিক নয়।  আমাদের কর প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ১৪ শতাংশ। কারণ বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ মেশিনারিজ আমরা এনেছি, এর কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া খাতভিত্তিক বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটা নিলে কর অনেক বেশি হতো। সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য শিল্পায়ন। ১৯৯৭ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট, ২০০৮ সালের সংকট আমরা মোকাবিলা করেছি। কোন কোন খাতে সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন সেটা খুঁজে বের করেছি। আগামীতে আমরা সবাইকে নিয়ে সফল হব। আমরা একটি ট্রানজিট পিরিয়ডে আছি। দ্রুত মানুষ এর সুফল পাবে।’ তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজার উঠবে, না নামবে, আমি তা নিয়ে কাজ করি না। আমার কাজ হচ্ছে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। শেয়ারবাজার নিয়ে আমরা কাজ করছি।’ ড. রেহমান সোবহান বলেন, ‘চীনের করোনাভাইরাসে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে। ভাইরাসের কারণে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাব ফেলবে। পণ্য, মেশিনারিজ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হতে পারে। সে জন্য এখনই আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু আর্থিক প্রবৃদ্ধিতে সংকটও রয়েছে। এসব সংকট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবউন্নয়ন সূচক, নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিহীন মানুষ দেশ ছেড়েছে। এখন সেটা নেই।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের সংকট মোকাবিলায় কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলার সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ জড়িত। বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগ চারগুণ বেশি। আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’ রেহমান সোবহান বলেন, ‘আইন, নীতিমালার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। এগুলো ঠিক করতে হবে। সবার জন্য সহজীকরণ করে সব ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। সমাজে অসমতা কমাতে হলে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।’ সালমান এফ রহমান বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সমালোচনা, আলোচনা হচ্ছে। এটা থাকবেই। কিন্তু ২০১০ সালে যদি কেউ বলত, ২০২০ সালে বাংলাদেশ বর্তমান পর্যায়ে আসবে, সেটা কেউ বিশ্বাস করত না। ২০০৮ সালে বাজেট ছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটা ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? অবশ্যই ‘প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এবং ধারাবাহিকতা আছে। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে প্রবৃদ্ধিতে অসমতা রয়েছে। সারা পৃথিবীর সব দেশেই উন্নয়নে অসমতা আছে। এটা প্রবৃদ্ধির অংশ। দেখতে হবে প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়ন হচ্ছে কি না। দারিদ্র্য কমছে কি না। গত ১০ বছরে দারিদ্র্যের হার অবশ্যই কমেছে। কর সংগ্রহে আমাদের ঘাটতি আছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শতভাগ অটোমেশন করতে পারলে দ্রুতগতিতে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমরা উন্নতি ঘটাতে পারব। ভবিষ্যতে কর আদায় বাড়বে।’ সালমান এফ রহমান বলেন, ‘কর রিফর্মে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন ও কর বৃদ্ধির হারে বিশ্বের তালিকায় শীর্ষ ২০ র‌্যাঙ্কিংয়ে ছিলাম। এ বছর অক্টোবরে র‌্যাঙ্কিংয়ে ওপরে এগোবে।’ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লেই যে উন্নতি হচ্ছে, এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। অর্থনৈতিক সূচকে শুধু রেমিট্যান্সই কিছুটা বাড়ছে। কিন্তু দেশ থেকে রেমিট্যান্স যাচ্ছে কত তাও দেখা উচিত। খেলাপি ঋণ আন্তর্জাতিক মানে নেই। প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। রাজনৈতিক চাপে অনেক সময় ঋণ দেওয়া হয়, যেগুলো পরে খেলাপি হয়ে যায়। এ ছাড়া ঋণ-আমানতের সুদের ব্যবধান বাংলাদেশে কখনই সাড়ে ৪ শতাংশের নিচে ছিল না। কিন্তু নয়-ছয়ের কারণে তা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যাবে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ কমবে। এ কারণে কমে যাবে কর্মসংস্থানের পরিধি। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সম্পদের স্বল্পতা আছে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ছড়াছড়ি। অদক্ষভাবে আমরা ব্যয় করছি। দুর্নীতি-অনিয়ম যেমন আছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অদক্ষতা রয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়লে এটা ধরে রাখতে হলে কৌশলগত চিন্তায় পরিবর্তন আনতে হবে। বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির। সেই মুক্তির ডাক শুধু ঐতিহাসিক নয়, এটা বিবর্তনে এখনো অনেক জরুরি ও প্রাসঙ্গিক। ৫০ বছর আগে আমরা কী ছিলাম, এখন কী আছি সেটা মেলাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি দুটি- গার্মেন্ট খাত ও প্রবাসী আয়। দুটি খাতই হলো অদক্ষ ও স্বল্প আয়ের শ্রমভিত্তিক। এই চালক দিয়ে মধ্য আয়ের দেশ গড়া যাবে না। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন উচ্চ শ্রমভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চ শ্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। দুটি খাতে প্রচুর ব্যয় হচ্ছে কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আমরা দিতে পারছি না। এ জন্য দায়ী মূলত অদক্ষতা, দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রতা। যারা প্রকল্প নিচ্ছেন তারা সঠিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনায় না নিয়ে করছেন। এটা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন বলেন, রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচক ভালো নয়। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ভালো নয়। সুদহার কমালেই সব সমাধান হবে না। তিনি বলেন, বিনিয়োগ করার জন্য পরিবেশ লাগে। বিনিয়োগের অন্য উপকরণগুলো সহজলভ্য করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন নেই। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অদক্ষতা রয়েছে। যোগ্যদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। সুদহার চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো দিক নয়। সঠিক তথ্যের ওপর ভর করেই নীতি নির্ধারণ করা উচিত। আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যথেষ্ট বৈষম্য রয়েছে। এ কারণে কোথাও কোথাও দারিদ্র্য রয়ে গেছে। উন্নয়ন শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিকই বেশি হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর