রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

২০০ গ্রামে নারী নির্যাতন নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের সর্বত্র নারী নির্যাতনের ছড়াছড়ি থাকলেও গারো পাহাড়ের আদিবাসী নারীরা পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার থেকে মুক্ত রয়েছেন। স্বামী যখন-তখন স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন না। ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে স্ত্রীকে বের করে দেওয়ার কোনো নজির নেই। স্ত্রীর মতে বা অমতে গারো পুরুষদের দ্বিতীয় বিয়ে করারও উদাহরণ নেই। ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নানা কারণে পাহাড়ি গারো জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকলেও সে সমাজের নারীরা প্রগতির নানা ধাপেই এগিয়ে রয়েছেন।

গারো পাহাড়বেষ্টিত কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, বকশীগঞ্জ, মধুপুর ও মুক্তাগাছা উপজেলার অন্তত দুই শতাধিক গ্রামে যুগ যুগ ধরেই এমন বৈষম্যহীন নারী জীবন চলছে বলে জানা গেছে। পাহাড় ও সমতল ভূমি মিলিয়ে তিন লক্ষাধিক গারো নারী ‘নির্যাতনমুক্ত সংসার’ সুবিধা ভোগ করতে পারছেন।

মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার প্রথা। পরিবারের সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত হওয়ায় সেখানে কদর থাকছে নারীদের। কী পরিবারে, কী সমাজ ব্যবস্থাপনায়-সর্বত্রই নারীদের মতামত যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে থাকে। নারীদের পরামর্শক্রমে পুরুষের উদ্যোগেই পরিচালিত হয় যাবতীয় কর্মকান্ড। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশজুড়ে পুরুষতন্ত্রের যে একচ্ছত্র বিস্তৃতি রয়েছে, তা থেকে গারো পাহাড়সহ মধুপুর গড়ের গারো নারী সমাজ অনেকটাই মুক্ত। সেসব স্থানেও নারীদের দমিয়ে রাখার নানা প্রবণতা যে একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা এখনো পরিবারের নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় আসীন। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরাও নারীর ক্ষমতায়নে ভূমির অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ ভূমির মালিকানার সূত্র ধরেই নারী উৎপাদনশীল খাতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে, যার মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে তাদের অবস্থান দৃঢ় হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতীতে পারিবারিক সম্পত্তি বলতে গারোরা বাদ্যযন্ত্র, জমির ফসল, সংরক্ষিত শস্য, থালা-বাসন, শূকর কিংবা সামান্য গয়নাগাটিকেই বুঝত। সময়ের পরিক্রমায় গারো সম্প্রদায় স্থায়ীভাবে বসবাসের শুরু থেকেই স্থায়ী বসতভিটা এবং তৎসংলগ্ন জমির মালিকানা নারীর ওপর বর্তাতে থাকে। পরিবারের ছেলেরা কোনো জায়গা-জমির ভাগ পান না। তারা স্ত্রীর ভাগে পাওয়া ভিটেমাটি, ফসলি জমি ঘিরেই নিজের সংসার সাজিয়ে তুলেন, কাটিয়ে দেন সারাটি জীবন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পারিবারিক জীবনে ঝগড়াঝাটি হয় না তা নয়, তবে উচ্চবাচ্য পর্যন্তই। স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করেছেন বা তাকে ফেলে আরেক নারীকে নিয়ে অন্য কোথাও ঘর বেঁধেছেন- এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। শিক্ষার প্রসার এবং পিতৃতান্ত্রিক বাঙালি সমাজের সঙ্গে অধিক মেলামেশার কারণে গারো পরিবারগুলোতে ছেলেরাও এখন মেয়েদের মতো জমির ভাগ চাইছে। পরিবার থেকে না জুটলেও নিজেদের উপার্জনের অর্থেও অনেক পুরুষ জমি কিনে মালিক বনে যাচ্ছেন। এতে নারীদের ভূমির মালিকানা স্বত্ব ক্রমেই কমে যাচ্ছে। স্থানীয়দের মাঝে পরিচালিত এক জরিপ সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল মধুপুর গড়ের গারো অধ্যূষিত গাছাবাড়ি পল্লীর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৫.২%) জমির মালিকানা বর্তমানে পুরুষদের হাতে। চুনিয়া গ্রামেও যথেষ্ট পরিমাণ জমির মালিকানা (১৯.৮%) রয়েছে পুরুষদের কাছে। কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থাপনায় তবুও পুরুষরা একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি করতে পারেননি। বরং ওই এলাকায় শিক্ষা-দীক্ষায় নারীরা আরও কয়েকধাপ এগিয়ে সব ক্ষেত্রে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারি কর্মস্থলেও গারো নারীরা নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। অন্যদিকে মাঠের ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জায়গা থেকেও পিছু হটেননি গারো পাহাড়ের নারীরা। তারা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন খেত-খামারে। সড়ক নির্মাণ, পুকুর খনন, সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ কর্মকান্ডেও যথেষ্ট অংশগ্রহণ রয়েছে গারো নারীদের। অনেক ব্যাপারে স্বাধীন হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছেন গারো নারীরা। প্রতিবেশী বৈরিতায় প্রায়ই গারো তরুণীরা ভিন্নজাতি পুরুষদের নিপীড়ন-নির্যাতন এমনকি হত্যাকান্ডেরও শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে গারো নারীদের মতো ‘নির্যাতনমুক্ত গৃহ’ লাভ করতে পারেনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার ৮০ শতাংশ পাহাড়ি নারী ঘরের বাইরে কাজ করে থাকেন। চলাফেরায় স্বাধীন মনে হলেও নিজ পরিবার ও সমাজে তারা নানারকম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সম্পদের ওপর পাহাড়ি নারীদের অধিকার নেই, সমাজ ব্যবস্থাও রয়েছে একচ্ছত্র পুরুষশাসিত। জীবনধারার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদের মতামত-পরামর্শের কোনো মূল্য দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। সেখানে তিন পার্বত্য পরিষদসহ সরকারি অন্যান্য কর্মকান্ডেও পাহাড়ি নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি।

সর্বশেষ খবর