রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বাবা-মা’র বিরোধ বলি দুই শিশু

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাবা-মা’র বিরোধ বলি দুই শিশু

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোড়ান বাজার সড়কের ৩৯৭ নম্বরে মোল্লা ভবন। শুক্রবার রাত ১টায় চারতলায় ৪/ডি নম্বর ফ্ল্যাটে দুই শিশুর আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙে পাশের বাসিন্দাদের। ‘আম্মু মাইরো না, প্লিজ মাইরো না, সরি আম্মু’- এমন আহাজারিতে ৪/সি ফ্ল্যাট থেকে ছুটে যান গৃহবধূ পারুল বেগম। দরজায় জোরে কয়েকবার কড়া নাড়ার পর ভিতর থেকে শিশু দুটির মা আরিফুন নেছা পপি (৩৫) বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এত রাতে দরজায় কে?’ পরিচয় জানার পর তিনি পারুলকে বলেন, ভাবী কিছু হয়নি, আপনি ঘুমান গিয়ে। কিছুক্ষণ পরই নীরব হয়ে যায় বাসাটি। কোনো সাড়াশব্দ নেই। যেন শিশু দুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রায় ৮ ঘণ্টা পরই গতকাল সকাল ৯টায় পপির বাসার সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটের দরজায় যান সেই পারুলই। কয়েকবার কড়া নাড়ার পর পপি ভিতর থেকে দরজা খুলে দেন। এ সময় তিনি আগুনে পোড়া ক্ষতবিক্ষত শরীর কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় ছিলেন। পারুল ভিতরে গিয়ে আঁতকে ওঠেন। ভাষা হারিয়ে ফেলেন তিনি। তার সামনে বিছানার ওপর মেহজাবিন আলফি (৯) আর জান্নাতুল ফেরদৌস (৬) দুই বোনের রক্তাক্ত লাশ। দুজনেরই গলা কাটা। মেঝেতে পানি আর তাজা রক্ত ভাসছিল। পরে খবর পেয়ে ওই ফ্ল্যাট থেকে এই দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে খিলগাঁও থানা পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে সিআইডির ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহ করেছে। এ সময় তাদের মাকে দগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ১৮ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে বলে জানান ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া। খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান জানান, শুক্রবার রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়। এরই জের ধরে পপি তার দুই মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পেরেছেন। সন্তানদের হত্যার পর তিনিও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে সন্দেহ তাদের। ওই নারী বাসায় একটা চিরকুটও লিখে রেখেছিলেন। ওই চিরকুটে তিনি তার সংসারের নানা অভাব অনটনের কথা উল্লেখ করেছেন। দুই সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে গতকাল দুপুর ১টার দিকে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন মোজাম্মেল হোসেন বিপ্লব (৪০)। খিলগাঁও থানায় এসে হাজির হলে তাকে দাম্পত্য কলহের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, তার স্ত্রীর মানসিক সমস্যা ছিল। আর চোখেও কম দেখতেন। এদিকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কথা বলছিলেন ওই দুই শিশুর মা পপি। এ সময় তার কথা অনেকটা অস্পষ্ট ছিল। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, শিশুদের বাবা তাদের দেখাশোনা করত না। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে ইলেকট্র্রনিকের ব্যবসা করে তার স্বামী বিপ্লব। কিন্তু ব্যবসার সব আয় তার ভাই হিসাব করেন। সে কোনো হিসাব রাখে না। তাদের ঠিকমতো টাকা-পয়সা দিতে চাইত না। টাকার কথা বললেই বকত। এই অশান্তির জন্য তিনি দুই সন্তানকে গলা কেটে হত্যার পর লাশ আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করেন এবং নিজের শরীরেও আগুন দেন। পপির ভাই অনিক জানান, তার বোনের স্বামী বিপ্লব ঢাকার বাইরে ব্যবসা করেন। এজন্য বাইরে থাকতেন তিনি। তার বোন পপি দুই মেয়েকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন। তাদের বড় মেয়েটি ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। ছোট মেয়েটি একই স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মা তার দুই মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করেছে। সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। ৪/সি ফ্ল্যাটের গৃহবধূ পারুল বেগমের ভাষ্য, বাচ্চা দুটোর চিৎকার শুনে, তাদের বাসার দরজায় জোরে ধাক্কা দেই। বাচ্চা দুটো যেভাবে কানতেছিল তাতে আমি মনে করছিলাম হয়তো ওই ভাবীর কিছু একটা হইছে। অনেক পরে দরজা না খুলেই ওপার থেকে ওই ভাবী বিরক্ত হইয়া বলে- কে? এত রাতে। আমি তখন বলি ভাবী আপনার কিছু হয়নি তো, মেয়েরা এত চিৎকার করতাছে কেন। তখন তিনি বলেন, কিছু হয়নি, ভাবী আপনি গিয়ে ঘুমান। পরে আমি চলে আসি। আসার পর আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। কিন্তু সকালে বাসার ভিতরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখি, তাতে আমার আর কোনো ভাষা ছিল না। ৪/এ ফ্ল্যাটের আরেক গৃহবধূ রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, ৮ মাস আগে তারা বাসাটি ৯ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিল। এই পরিবারের লোকজন অন্যদের সঙ্গে তেমন মিশত না। নিহত বাচ্চাদের মা পর্দানশিন ছিলেন। তিনি মেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন। সিঁড়িতে এটুকুই শুধু দেখা যেত। প্রায়ই তিনি বাচ্চাদের মারধর করতেন। বাইরে থেকে তা বোঝা যেত। গতকাল সকাল ৯টায় ওনার বাবা আবু তালেব মিয়া তাড়াহুড়ো করে আসেন। তখন তিনি হায় হায় করতে করতে বলছিলেন, এ পপি তুই এ কী করলি। আমরা তার এই অবস্থা দেখে ওই বাসার দরজার সামনে যাই। খুব জোরে বাইরে থেকে দরজা খোলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছিলেন আবু তালেব মিয়া। কিন্তু দরজা খুলছিল না। অনেক পর ভিতর থেকে দরজা খুলে দেওয়া হয়। এরপর দুই রুমের বাসার ভিতরে রুমে গিয়ে দেখি বিছানার ওপর বাচ্চা দুটো শোয়ানো। দুজনের গলা কাটা। আর মেঝেটা ছিল রক্ত আর পানিতে ভরা। তাদের মা সামনের রুমে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে ছিলেন। এ সময় তিনি তার বাবাকে বলছিলেন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না, ১৩টা বছর ধরে অশান্তিতে আছি। বাসার ভিতরে দৃশ্য দেখার পর আমি আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারিনি। শিশুদের বাবা মোজাম্মেল হোসেন বিপ্লব আহাজারি করে সাংবাদিকদের জানান, তার মেয়ে দুটি অনেক মেধাবী ছিল। আগে তার স্ত্রী পপি তার বাবা-মার সঙ্গে থাকত। পপির ভাই বিয়ে করলে তাকে আলাদা বাসা নেওয়ার কথা বলে। পরে দক্ষিণ গোড়ানের ওই বাসাটি তিনি ভাড়া নেন। তার স্ত্রী প্রায়ই সামান্য বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করত। তিনি প্রায়ই থাকতেন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে। মাঝে মাঝে এ বাসায় আসতেন। শ্রীনগর বাজারে তার ইলেকট্র্রনিক্সের ব্যবসা আছে। ব্যবসা খারাপ হওয়াতে তার একটু অভাব চলছিল। মেয়েদের প্রাইভেটের কথা বলে তার স্ত্রী অতিরিক্ত টাকা চাইতেন। তিনি বলতেন কিছুদিন পর প্রাইভেট দিতে। কারণ তার টাকা-পয়সার সমস্যা চলছিল। এ নিয়ে তাদের মনোমালিন্যও চলে। শুক্রবার রাত ৯টায় স্ত্রী পপির সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। তাকে ঢাকায় আসতে বলেছিল। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, একটু ঝামেলা আছে, তিনি রবিবার আসবেন। হাত খরচের জন্য তিনি তার মোবাইলে বিকাশ অ্যাকাউন্টে ১৫০০ টাকাও পাঠান।

সর্বশেষ খবর