মঙ্গলবার, ১০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

নতুন কেউ আক্রান্ত হয়নি, ভর্তি রোগীদের চলছে চিকিৎসা ৪০ জন কোয়ারেন্টাইনে

রাজধানীতে ৪০০ বেডের আলাদা হাসপাতাল, জেলা-উপজেলায় ওয়ার্ডের ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েনি। গত রবিবার শনাক্ত হওয়া রোগীদের চিকিৎসা চলছে। তারা সুস্থ আছেন। তবে আক্রান্ত একজনের সংস্পর্শে আসা ৪০ জনকে সতর্কতামূলক কোয়ারেন্টাইনে (আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ) রাখা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য ঢাকার পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত আছে বিভিন্ন হাসপাতালের প্রায় ৪০০ শয্যা। এদিকে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে কারও মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েনি বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-

আইইডিসিআর। গতকাল আইইডিসিআরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সংস্থার  পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে তিনজন আক্রান্ত হওয়ার খবর জানানোর পর ২৪ ঘণ্টায় ৫০৯টি ফোনকল এসেছে আইইডিসিআরের হটলাইনে। তার মধ্যে ৪৮৯টি কলই ছিল নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে। এ সময় ৪ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। তাদের কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মেলেনি। তার মানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এখনো তিনজন। আইইডিসিআর রবিবার এক ব্রিফিংয়ে দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করে।

যেসব দেশে নভেল করোনাভাইসের প্রকোপ বেশি,  সেখান থেকে কোনো প্রবাসী বাংলাদেশি ফিরে এলে তাদের ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থান করার পরামর্শ দেন অধ্যাপক ফ্লোরা। এ বিষয়ে স্বজনদের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, এই ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের ক্ষেত্রে স্বজনদেরও সচেতন থাকতে হবে। তিনি যদি ভুল করে বাড়ি থেকে বের হয়েও যান, তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে তিনি কোয়ারেন্টাইনে আছেন। বিদেশ-ফেরতদের সঙ্গে অনেক সময় যে বিরূপ আচরণ করা হচ্ছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে ডা. ফ্লোরা বলেন, এর ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা খবর পাচ্ছি শঙ্কিত হয়ে প্রতিবেশী এবং বাড়িওয়ালারা তাদের (বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের) সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছেন। আমরা যদি তাদের সহযোগিতা না করি তাহলে তাদের বাসা থেকে গিয়ে হোটেলে বা বাইরে থাকতে হবে। আর তারা যদি সংক্রমিত হয় তাহলে এটি আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। সেজন্য তারা যেন বাড়িতে থাকেন সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডা. বর্ধন জং রানা উপস্থিত ছিলেন এ সংবাদ সম্মেলনে। করোনাভাইরাস সবখানে ছড়িয়ে গেছে, এ কারণে বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন ডা. রানা। তিনি বলেন, এখন সবাইকে নিয়ে এটা প্রতিরোধ করতে হবে। কতটা আগে রোগটি শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটি হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশকে এখন এই চ্যালেঞ্জটি নিতে হবে।

প্রস্তুতি সারা দেশে : এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে ৪০০ বেডের আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসব তথ্য জানান। মন্ত্রী জানান, রাজধানীর উত্তরায় কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালকে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রাখা হয়েছে। এখানে ২০০ বেড রয়েছে। এর বাইরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ১০০ বেডের আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে। এরপরও প্রয়োজনে শয্যা আরও বাড়ানো হবে। তিনি জানান, রাজধানীর বাইরে সারা দেশেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশের বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ৩০০, জেলা সদর হাসপাতালে ১০০ এবং উপজেলা সদরে ৫০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিদেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, আমি বলব, দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে এই মুহূর্তে আপনারা দেশে আসবেন না। নিজ নিজ স্থানে থাকুন। এটা আগেও আমরা বলেছি। রাষ্ট্রদূতদের আমরা নির্দেশনা দিয়েছি- তাদের জন্য সেইফ জোনের ব্যবস্থা করতে। তিনি বলেন, বিদেশফেরত বিশেষ করে করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আসা বাংলাদেশিদের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাদের পরীক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজন হলে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে খবর দেওয়া হয়েছে, যারা আসবেন (বিদেশফেরত) সেলফ-কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। তার যারা প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন- বিষয়টি আমাদের জানাবেন। আমরা তাদের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেব। জাহিদ মালেক বলেন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম আমরা আগে থেকেই নিয়েছিলাম। এখন নতুন করে পোস্টার ও ব্যানার তৈরি করা হচ্ছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে তা সারা দেশে পৌঁছে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, দেশে তিনজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হলেও আপাতত স্কুল স্বাভাবিকভাবে চলবে। সারা দেশের স্কুল ও কলেজগুলোতে হাত ধোয়ার জন্য সরকারিভাবে বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, খেলাধুলা, ধর্মীয় বা সামাজিক প্রোগ্রাম সীমিত করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এগুলো না করলেই ভালো। এ বিষয়ে ডিসিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

৪০ জন কোয়ারেন্টাইনে : বাংলাদেশে যে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের একজনের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ৪০ জনকে তাদের বাড়িতেই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল হক। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি এ তথ্য জানান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্বাস্থ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়েই মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে আসেন। তারা দুজনেই বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বড় ধরনের জনসমাগমের অনুষ্ঠান এড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব আসাদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, অবশ্যই আছে। এই আশঙ্কা রোধের জন্য আমরা ব্যবস্থাও নিয়েছি। তাদের কন্টাক্ট ট্র্যাকিং করে কোথায় গেছে, কাদের সঙ্গে মিশেছে, সবকিছু করে আমরা প্রথমজনের জন্য ৪০ জনকে ট্র্যাক করেছি, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করেছি। প্রটোকল অনুযায়ী ব্যবস্থা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা হয়েছে, ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা হয়েছে। বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিং শিথিলতার প্রসঙ্গে সচিব বলেন, এই ভাইরাসের প্রকৃতিটা একটু জানা দরকার। ভাইরাস যদি থাকে তবে সঙ্গে সঙ্গে জ্বর আসবে না, ধরা পড়বে না বা উপসর্গ দেখা দেবে না। ১৪ দিন পর্যন্ত এটা উপসর্গ দেখা নাও দিতে পারে। যখন উনি দেশে এসেছেন কোনো উপসর্গ ছিল না। এটা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। স্ক্যানিংয়ে তার জ্বর ধরা পড়বে না তাই যে কেউ চলে আসতে পারবে। আমরা ব্যবস্থা করেছি যে, তাদের (বিদেশ-ফেরত যাত্রী) একটা লোকেটর ফরম দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সে কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে সেটা লেখা থাকবে। যদি কোনো উপসর্গ দেখা দেয় সে যোগাযোগ করবে। এর ভিত্তিতে মোবাইল ট্র্যাক করি, কোন দেশ থেকে এলো, কোথায় আছে তারাও যোগাযোগ করে হটলাইনে যে, জ্বর আসছে, কাশি হচ্ছে। এভাবে আমরা ১০০ জনের মতো লোককে টেস্ট করেছি। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আসা দুজনের শরীরে ধরা পড়েছে।

যেসব হাসপাতালে চিকিৎসা মিলবে : স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহজনক রোগীদের জন্য রেফারেন্স হাসপাতাল হিসেবে দেশের কয়েকটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। হাসপাতালগুলো হলোÑ মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালগুলো গতকাল থেকে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেছে।

হটলাইন ১৩টি : বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের রোগী ধরা পড়ার পর মানুষের ফোনকলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হটলাইন নম্বরও চারটি থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করেছে সরকার। এখন নভেল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য পেতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই ১৩টি নম্বর সবসময় খোলা পাওয়া যাবে। হটলাইন নম্বরগুলো হচ্ছে- ১৬২৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইনের নম্বরটিও (১৬২৬৩) এখন নভেল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য জানাতে ব্যবহৃত হবে। বাকি ১২টি নম্বর আইইডিসিআরের। করোনাভাইরাস নিয়ে গতকাল নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সেবার পরিধি বাড়াতে হটলাইনে নম্বর যোগ করা হয়েছে। এতে সার্ভিস সংক্রান্ত তথ্য পাবেন। কারও নমুনা সংগ্রহের যদি প্রয়োজন মনে হয়, তারাও (স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইন) আমাদের জানাবেন নমুনা সংগ্রহ করতে হবে কি-না।

সর্বশেষ খবর