বুধবার, ১১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

বিমান ও স্থলবন্দরে বসেনি নতুন থারমাল স্ক্যানার, পুরনোগুলো নষ্ট, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে কিছু শয্যা ছাড়া নেই কোনো প্রস্তুতি, বাজারে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সংকট, কমিটিগুলোরও কার্যকারিতা নেই

জুলকার নাইন ও গোলাম রাব্বানী

মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

১. উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা, ২ ও ৩. ফার্মেসিতে বিক্রি শেষ মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিশ্বের কোনো বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরে প্রবেশের সুযোগ নেই। কিন্তু দুই মাস ধরে বিশ্বব্যাপী করোনা আতঙ্ক চলতে থাকলেও বাংলাদেশে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরে থারমাল স্ক্যানার বসানোর কাজ পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। নষ্ট ও অচল হয়ে আছে পুরনো বেশির ভাগ স্ক্যানার। নতুন পাঁচটি থারমাল স্ক্যানার বসানোর কথা শোনা গেলেও সেগুলোর দেখা পাওয়া যায়নি। শুধু বন্দরের স্ক্যানার নয়, করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য কিট এবং সেবক (নার্স) ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিরও ঘাটতি প্রকট। প্রস্তুতির এত সময় থাকলেও বাজারে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সংকট। হাসপাতালের প্রস্তুতিসহ অনেক বিষয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোয় শুধু কিছু শয্যা প্রস্তুত ছাড়া তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেই। আবার সরকার গঠিত কমিটিগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। কমিটিতে থাকা চিকিৎসকের কেউ কেউ ইতিমধ্যে বলেছেন, কমিটিতে থাকার বিষয়টি তিনি নিজেই জানেন না। ঢাকার শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. শাহারিয়ার সাজ্জাদ গতকাল এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, যাত্রীর মাত্রাতিরিক্ত চাপে বিমানবন্দরে স্থাপন করা থারমাল স্ক্যানারটি অচল হয়ে পড়েছে। কারণ স্বাস্থ্য ডেস্ক হলো মাত্র দুটি। লোকও আছেন মাত্র ছয়জন। তাদের দিয়ে একসঙ্গে চার-পাঁচ শ লোককে পরীক্ষা করা কঠিন। যাত্রীরাও অনেক সময় অধৈর্য হয়ে পড়েন। তারা চাপ ?সৃষ্টি করেন। এ কারণে যে থারমাল স্ক্যানারটা ভালো ছিল, সেটিও নষ্ট হয়ে পড়ে। এখন বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে হাত দিয়ে ইনফ্রারেড থারমোমিটার দিয়েই যাত্রীদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, ‘আগের স্ক্যানারগুলোই তো নষ্ট। শাহজালাল বিমানবন্দরে তিনটি থারমাল স্ক্যানার রয়েছে। এর দুটি নষ্ট। শুধু ভিআইপি যাত্রীদের জন্য বসানো স্ক্যানারটি সচল আছে। নতুন থারমাল স্ক্যানার বসানোর কথা বলা হলেও আমরা সেগুলো পাইনি। এ ছাড়া সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের থারমাল স্ক্যানারগুলো আগে থেকেই নষ্ট হয়ে আছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জানানো হয়েছে।’ বেবিচক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জনবল সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লোক কম থাকায় আমরা সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে তাদের সহায়তা করছি। কারণ একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট এলে দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি হয়। এসবসহ সার্বিক বিষয় স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জানানো হয়েছে।’ জানা যায়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঁচটি থারমাল স্ক্যানার বসানোর কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। পাঁচটি নতুন থারমাল স্ক্যানারের মধ্যে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরে একটি করে থারমাল স্ক্যানার বসানো হবে। এর মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দরের জন্য থারমাল স্ক্যানার মাত্র এসেছে। আর গতকাল চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে থারমাল স্ক্যানার বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। শুধু স্ক্যানার নয়, বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনরত স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে কোনো কর্মকর্তারই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় পোশাক ও সরঞ্জাম নেই। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সীমান্তের স্ক্রিনিং যে শতভাগ হচ্ছে এমনটা বলার সুযোগ নেই। সাধ্যানুযায়ী সীমান্তে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে দেশে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে প্রতিটি মানুষকে পৃথক করে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়বে। হাসপাতালগুলোয় সংক্রমণ ঠেকানোর ব্যবস্থাও দুর্বল। যে কোনো সংক্রামক রোগের জন্য যে ইনফেকশন প্রিভেনশন কমিটি (আইপিসি) রয়েছে, সেগুলোকে সক্রিয় করা দরকার।’ প্রস্তুতিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘দরকার ছিল হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করা। কিন্তু হাসপাতালগুলোকে তেমন সতর্ক করা হয়নি। এ ছাড়া যদি বেশি রোগী চলে আসে, তখন তাদের কোথায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হবে তাও একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। যেহেতু আমাদের হাসপাতালগুলোয় অনেক রোগীর ভিড়, সে তুলনায় স্থান কম, করোনা আক্রান্তরা অন্য রোগীদের সঙ্গে মিশে গেলে রোগটা ছড়িয়ে পড়বে। হয়তো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তা কীভাবে করা হবে- এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ।’ স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি যথেষ্ট। কারণ ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে দেশের সকল পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে করোনা ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে, সে ওয়ার্ডে শুধু কিছু শয্যা প্রস্তুত করা ছাড়া তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। এমনকি এ ভাইরাসজনিত রোগটির চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক ও নার্সদের পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্টসহ (পিপিই) অন্য কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। হাসপাতালের উপ-সেবা তত্ত্বাবধায়ক (ডেপুটি নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট) আছমাতুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘করোনা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নেই বললেই চলে। এখানে ৩৮০ জন নার্স আছেন। ১৫টি মাত্র গাউন ও ১৫টি মাস্ক পাওয়া গেছে। কোনো গ্লাভস নেই, কোনো শু (জুতা) নেই। নিজ থেকে কেউ ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বে কাজ করতে চাইছেন না। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ আমরা পাইনি। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া লিফলেটই ভরসা।’ এ পরিস্থিতি শুধু খুলনায় নয়, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালে একই অবস্থা বিরাজ করছে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়েই কভিড-১৯ পরীক্ষা করার কিটের অপ্রতুলতা রয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। বিশ্বজুড়েই এর অপ্রতুলতার কারণ হলো, এটি একটি নতুন ভাইরাস। প্রতিনিয়ত কিট তৈরি করা হচ্ছে এবং এর ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উদ্যোগে কিটগুলো বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে।’ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেছেন, ‘করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিকল্পনা তৈরির সময় সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। আসলে বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াবহতার তুলনায় বাংলাদেশে তেমন প্রস্তুতি নেই।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর