বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজনীতিতেও করোনার আঘাত

আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা সম্মেলন বন্ধ, জনসমাগম এড়িয়ে মুজিববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি, খালেদার মুক্তি দাবিতে বিএনপির সভা-সমাবেশ স্থগিত, জেলা-উপজেলায় কোনো শোডাউন নয়

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

সামাজিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এবার আঘাত হেনেছে নভেল করোনাভাইরাস। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে-ময়দানের শোডাউনমূলক সব কর্মসূচি সাময়িক বন্ধ রেখেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আসন্ন পাঁচটি উপনির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। উৎসাহ-উদ্দীপনার বদলে ওই সব এলাকায় বিরাজ করছে নানা আতঙ্ক। রাজনীতিতে এখন আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাস। এই সংক্রামক মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘জাতীয় ঐক্যের’ কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজ নিজ উদ্যোগে করোনার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা শুরু করেছে।

সূত্রমতে, সোমবার বিকালে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ঘোষণার পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রাতে জরুরি বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান সীমিত করা হয়। এমনকি মুজিব জন্মশতবর্ষের মূল অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে অন্য কোনো বড় জমায়েত না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৩০ মার্চ অনুষ্ঠেয় প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ জাপান সফর স্থগিত করা হয়েছে। একইভাবে স্থগিত করা হয়েছে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর দেশের বাইরের বিভিন্ন কর্মসূচি।

ঢাকা-১০ সংসদীয় আসনের আসন্ন উপনির্বাচনের প্রচারে জনসমাগম এড়িয়ে চলছেন প্রধান দুই দলের নেতা-কর্মীরা। প্রার্থীরাও নেতা-কর্মীদের দলবল নিয়ে ভোটারদের ঘরে ঘরে যাওয়ার বদলে স্বল্প পরিসরে গণসংযোগ, মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো, অনলাইন ও টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। শূন্য হওয়া বগুড়া-১, যশোর-৬, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলেও সেসব এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে জনসমাবেশের আয়োজন করছে না কোনো দল। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) আসন্ন নির্বাচন ঘিরেও আগের মতো নেতা-কর্মীর ভিড় নেই।

এদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন সাময়িক বন্ধ রেখেছে। অন্যদিকে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও স্থগিত রেখেছে তাদের সভা-সমাবেশ কর্মসূচি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বড় কোনো জনসমাগম হয় এমন কর্মসূচি আপাতত না দিতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনা আতঙ্কে আগামী ১৪ মার্চ সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন মুলতবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও জনসমাগম হয় এমন কর্মসূচি আপাতত স্থগিত রেখেছে।

আওয়ামী লীগ : মুজিববর্ষ দেশব্যাপী জাঁকজমকপূর্ণ করার সব ধরনের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের। ১৭ মার্চ জাতীয়ভাবে এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে ৮৭ হাজার লোকের সমাগম ঘটানোর সব ধরনের প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে ছিল। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্যরা সহযোগী সংগঠন, ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও একাধিক বৈঠক করেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সব প্রস্তুতি থাকার পরও জনসমাগম ঘটবে এমন কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে দলটি। সোমবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে জনসমাগম না ঘটিয়ে যথাযথ মর্যাদায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করব। তবে মানুষকে কষ্ট দিয়ে নয়। সে কারণে আপাতত জনসমাগম করা হচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা নিয়ে সরকারের প্রস্তুতি আছে বলেই মুজিববর্ষের মতো অনুষ্ঠানকে কাটছাঁট করা হয়েছে। মুজিববর্ষে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পর্যন্ত স্থগিত করে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। আমরা জনসমাগম থেকে বিরত থাকতেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’

দলীয় সূত্রমতে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে জেলা-উপজেলার প্রবীণ নেতাদের সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি ছিল ক্ষমতাসীন দলটির। আপাতত তা করা হচ্ছে না। জেলা-উপজেলায় মুজিববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে র‌্যালি, সমাবেশ, জনসভাও স্থগিত করা হয়েছে। আগামী এপ্রিলে যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগের সম্মেলনের সম্ভাব্য সময় ছিল। কিন্তু তাও পিছিয়ে যাচ্ছে। গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সহযোগী সংগঠনগুলোকে জুনে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে মুজিববর্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়, প্রবেশদ্বারগুলো ভিন্ন সাজে সাজানো হবে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে আমরা ব্যাপক আয়োজনের প্রস্তুতি রেখেছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে জনসমাগম স্থগিত করেছি। কারণ প্রধানমন্ত্রী চান দেশের মানুষ যেন ঝুঁকিতে না পড়ে। সে কারণে আপাতত জনসভা, জনসমাগম স্থগিত করা হয়েছে। তবে ঢাকাসহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়ে সাজসজ্জা করা হবে। সমাবেশ না করেও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীকে কালারফুল করতে যা যা করা দরকার তা করব।’

বিএনপি : দলীয় সূত্রমতে, কঠোর কর্মসূচি না দিলেও খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। দলের স্থায়ী কমিটিতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়। কিন্তু হঠাৎই বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ায় রাজপথের শোডাউনমূলক সব কর্মসূচি থেকে আপাতত বিরত থাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। শুধু জনগণকে সচেতন করতে এবং আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়ে কীভাবে মানুষের সেবা করা যায়, সেসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিএনপিও রাজনৈতিক দল হিসেবে গণসচেতনতামূলক কর্মকান্ড চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। দলীয় শোডাউনমূলক সব কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সারা দেশে গতকাল বিক্ষোভ করার যে কর্মসূচি দিয়েছিল দলটি, তা স্থগিত করা হয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে করোনা মোকাবিলা-সংক্রান্ত লিফলেট তৈরি করা হচ্ছে। শিগগিরই সারা দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এ লিফলেট বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এর মধ্যে ঢাকা-১০ আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী শেখ রবিউল আলম করোনা সচেতনতায় লিফলেট বিতরণ করে জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির হাইকমান্ড সূত্রে জানা গেছে, চার উপনির্বাচন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বড় ধরনের শোডাউন না করে সীমিত পরিসরে গণসংযোগ চালানোর দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জনসভা কর্মসূচি স্থগিত করতেও দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা। একই সঙ্গে সবাইকে মাস্ক পরে গণসংযোগে যেতে বলা হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, করোনা সংকট না কাটা পর্যন্ত জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন করে কোনো কমিটি না করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বড় জমায়েতের কোনো কর্মসূচিও আপাতত দেওয়া হবে না বলে কেন্দ্র থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে তৃণমূলে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। জনসমাবেশে যাতে কেউ এ ভাইরাসের ঝুঁকিতে না পড়ে সেজন্য আমরা সারা দেশে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করেছি। আমরা আক্রান্তদের আশু আরোগ্য কামনা করছি। এ রোগ যাতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য মহান রব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করছি। দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সারা দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনার অনুরোধ করছি। এ ছাড়া দুস্থ রোগীদের সুচিকিৎসা এবং রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সরঞ্জাম নিয়ে জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

করোনা আতঙ্কে সিলেট জাতীয় পার্টির সম্মেলন স্থগিত : নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, করোনাভাইরাস আতঙ্কে সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির ১৪ মার্চের সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নির্দেশে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির সিলেট জেলা শাখার নেতারা। গতকাল দুপুরে নগরের একটি হোটেলের হলরুমে প্রেস ব্রিফিং করে সম্মেলন স্থগিতের বিষয়টি জানান জাতীয় পার্টির সিলেট জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও সিলেট বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব এ টি ইউ তাজ রহমান।

প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের সব উপজেলা ও জেলা সম্মেলন স্থগিত করেছেন। তার নির্দেশে সিলেট জেলা জাতীয় পার্টিরও সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব মো. উছমান আলী, সদস্য মো. আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, মকসুদ ইবনে আজিজ লামা, শরফ উদ্দিন খসরু, সাইফুদ্দিন খালেদ, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক খান, নাসির উদ্দিন হেলাল প্রমুখ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর