বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আবারও পুড়ে ছাই বস্তি

আহাজারি, ভিক্ষুক খোয়ালেন জমানো ৫০ হাজার টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আবারও পুড়ে ছাই বস্তি

রাজধানীতে আগুনে আবারও পুড়ল বস্তির কয়েক হাজার ঘর। রূপনগরে রজনীগন্ধা অ্যাপার্টমেন্টের পেছনে ঝিলের ওপর গড়ে ওঠা বস্তির ‘ত’ ব্লকের একটি ঘর থেকেই আগুনের সূত্রপাত। গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে শুরু হওয়া এ আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় আশেপাশে। পুড়তে থাকে মাচার ওপর বাঁশ ও টিনের তৈরি ছাপড়া ঘরগুলো। ধোঁয়ার কুন্ডলীতে অন্ধকার হয়ে যায় পুরো এলাকা। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট ৩ ঘণ্টার চেষ্টায় ভয়াবহ এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ওই বস্তিতে ১০ হাজারেরও বেশি ঘর ছিল উল্লেখ করে স্থানীয়রা জানান, যার অধিকাংশই পুড়ে গেছে।

এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিঃস্ব হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। হাতের কাছে পাওয়া মালপত্র নিয়েই পাশের রাস্তায় আশ্রয় নেন অনেকে। চোখের পলকে সহায়-সম্বল হারিয়ে শুধুই আহাজারি করতে দেখা গেছে। অবশিষ্ট কিছু পাওয়ার আশায় পুড়ে যাওয়া ঘরে খোঁজাখুঁজি করেছেন অসহায় এসব মানুষ। ‘ত’ ব্লকের সুমনের বস্তির বাসিন্দা ভিক্ষুক খাদিজা বেগমের তিল তিল করে জমানো ৫০ হাজার টাকাও পুড়ে ছাই হয়েছে এ আগুনে।

রূপনগরে ঝিলপাড় বস্তির পাশে মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনের চলন্তিকা বস্তিতে গত বছর আগস্টে এবং চলতি বছর জানুয়ারিতে দুই দফা অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এবারও এ বস্তিতে আগুন লাগার কারণ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে। এনু মিয়া নামে একজন বলেন, এটি কারও লাগানো আগুন। কোনো দুর্ঘটনা নয়। যেখানে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত, তার পাশেই দেখা যায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা ছিল- জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সম্পত্তিতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের পুনর্বাসনের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্ধারিত স্থান। প্রাথমিকভাবে রূপনগর বস্তির আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি সংস্থাটির কর্মকর্তারা। আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

দুপুর সাড়ে ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর বিভিন্ন আসবাবপত্র দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা ছিল। যে কারণে গাড়ি ঢুকতে একটু সমস্যা হয়েছে। আশপাশে প্রচুর পানি সংকট ছিল, বিভিন্ন ভবনের রিজার্ভার থেকে পানি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ডাম্পিং করা শুরু হয়। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আগুনে বস্তির প্রায় ৫০ শতাংশ ঘর পুড়ে গেছে। বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, আগুনের সূত্রপাত ভাঙ্গাড়ি মজিবরের ঘর থেকে। আবার কেউ বলছেন আতিকের ঘর থেকে সূত্রপাত।

বস্তি এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রজনীগন্ধা মার্কেট থেকে বস্তির দূরত্ব কয়েক মিটার। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি মার্কেটের পাশ হয়ে আরামবাগ পয়েন্ট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষের ভিড়ের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাড়ি ঢুকতে একটু সময় লাগে। পরে ভিড় কমাতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থীরা মানব ঢাল তৈরি করে রাস্তায় ব্যারিকেড দেন। তাদের সঙ্গে রোভার স্কাউটসের সদস্যরাও উৎসুক জনতার ভিড় কমাতে কাজ শুরু করেন।  

আগুনের ঘটনায় আশপাশের গার্মেন্টগুলোতে মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাদের কর্মীদের ছুটি দেওয়া হয়। ওই বস্তিতে গার্মেন্টকর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করতেন বলে জানা গেছে।

ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, আগুন লাগলে তারা ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু কোনো মালামাল ঘর থেকে বের করে আনতে পারেননি। আগুন লাগার পর হাতের কাছে যে যা পেয়েছেন তা নিয়ে রূপনগর আবাসিকের ৯/১ নম্বর রোডের পাশের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর পার্কিংয়ে, রাস্তার দুই পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। 

আহাজারি করতে করতে তাসলিমা বেগম নামে বস্তির এক বাসিন্দা জানান, সকাল ১০টার দিকে আগুনের খবর শুনে বনানী থেকে ছুটে আসি বস্তিতে। আমি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে চাকরি করি। আমার স্বামী আলাউদ্দিন ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করেন। সাড়ে ৩ হাজার টাকায় ভাড়া নেওয়া বস্তির দুই ঘরের মধ্যে একটি আমরা আর অন্যটিতে থাকত দুই ছেলে। ঘরের টিনসহ সব আসবাবপত্র পুড়ে গেছে।

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন স্থানীয় এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বস্তিবাসীর জন্য যত ধরনের সহযোগিতা দরকার আমরা করব। সরকারি প্রশাসনের বাইরে আমাদের প্রত্যেক নেতা-কর্মী বস্তিবাসীর পাশে থাকবে। অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর জন্য পাশের একটি স্কুলে আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তাদের জন্য দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বস্তিতে প্রায় ১০ হাজার ঘরের অধিকাংশই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আগুনের মধ্যে চোরের উৎপাত : রূপনগর ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকান্ডের পরই নিজের জীবন আর কষ্টের টাকায় কেনা আসবাবপত্র বাঁচাতে ছোটাছুটি করছিলেন বাসিন্দারা। তখনই সেখানে তাদের মাথায় আরেক বিপদ এসে চেপে বসে। দিনদুপুরে শুরু হয় চোরের উৎপাত। বস্তির উত্তর দিকের আগুন দেখে মাঝখানের এবং দক্ষিণের বাসিন্দারা তাদের মালামাল নিরাপদ স্থানে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘর থেকে একটি করে জিনিসপত্র বের করে এনে রাস্তার পাশে রাখছেন, আরেকটি আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখেন আগের রাখা সেই জিনিস তার নেই। মোহাম্মদ ইসহাক নামে একজন জানান, আগুনের আতঙ্কে ঘরের ফ্যান খুলে রাস্তার পাশে রেখে খাট বের করতে গিয়ে এসে দেখেন তার ফ্যান নেই। জুলেখা নামে এক নারী জানান, তার খাটের একপাশের বাতা, রেক, টিভি এবং কয়েকটা কামিজ চুরি হয়ে গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর