বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
একই বস্তিতে বারবার আগুন

বড় লোকের বিল্ডিং বানাতে পুড়ে যায় গরিবের ঘর

সাঈদুর রহমান রিমন

প্রভাবশালী মহলের নানা প্রলোভন আর সরকারি দফতরের বুলডোজার ব্যর্থ হলেই কি আগুন লাগে বস্তিতে? রাজধানীর মিরপুর রূপনগর ঝিলপাড়, শিয়ালবাড়ী, কালশী ও দোয়ারীপাড়ায় পর পর কয়েকটি আগুন লাগার ঘটনায় এ প্রশ্নই উঠেছে জনমনে। বস্তির জায়গার ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়লেই স্থানীয় দাপুটে জনপ্রতিনিধি সে বস্তিবাসীর ত্রাতা সেজে এগিয়ে যান, এরপর নানা স্বপ্ন ও স্থায়ী পুনর্বাসনের লোভ দেখিয়ে আপসে জায়গা কবজায় নেওয়ার চেষ্টা চালান। এতে ব্যর্থ হলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদফতর কিংবা সরকারি অন্য কোনো সংস্থাকে জায়গার মালিক সাজিয়ে টার্গেটকৃত বস্তি উচ্ছেদের তোড়জোড় চলে। দেওয়া হয় উচ্ছেদ নোটিস, শুরু হয় মাইকিং। চেষ্টা চলে বস্তিবাসীর মধ্যে দলাদলি বাধানোর নানা পাঁয়তারা।

একপর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে বস্তি উচ্ছেদের জন্য পাঠানো হয় বুলডোজার। চলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা। কিন্তু উপায়ান্তরহীন বস্তির বাসিন্দারা প্রতিবাদী হয়ে উঠলে কিছুদিন বিরতি দিয়েই সেখানে হঠাৎ জ্বলে ওঠে আগুন। সে আগুন নেভানোর উদ্যোগেও সংঘবদ্ধ ভূমি দখলবাজরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে কোনো বস্তির একটি ঘরে আগুন লাগলেও ওই চক্রের পাহারায় গোটা বস্তি পুড়িয়ে দেওয়ার নানা কৌশল ব্যবহার করারও নজির রয়েছে। মিরপুর, পল্লবী, রূপনগর এলাকার প্রতিটি বস্তিতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

 

মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তৃতীয় দফার আগুনে এবার পুড়ে গেল রূপনগরের শিয়ালবাড়ী বস্তি। তিন ঘণ্টার আগুনে এ বস্তির সহস্রাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ল অন্তত ২০ হাজার মানুষ। এর আগে ২৫ জানুয়ারি ও গত বছর ১৭ আগস্ট পৃথক দুটি অগ্নিকান্ডেও রূপনগর বস্তির চার সহস্রাধিক ঘর পুড়ে লাখো মানুষ সব হারিয়ে দিগি¦দিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।

১৭ আগস্ট ঝিলপাড়ের বৃহত্তম বস্তি পুড়ে ছাই হতেই সেখানে হাজির হন স্থানীয় একজন এমপি। বস্তির বাসিন্দাদের কিছু দিন অন্য কোথাও অবস্থান নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তখন তিনি বলেছিলেন, এখানে বস্তিবাসীর স্থায়ীভাবে বসবাসের সব ব্যবস্থা তিনি করে দিচ্ছেন। এ লক্ষ্যে কথিত ডিজিটাল তালিকা তৈরি করে নানা রকম নকশা আঁকাআঁকির কাজও শুরু হয়। কিন্তু মাস দেড়েক আগে পরপর দুই রাতেই পোড়া বস্তির পুরো জায়গায় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি গড়ে ওঠে। এমপির সমর্থক কারেন্ট দুলাল, ত ব্লকের রহিম, সাবেক কাউন্সিলর রজ্জব আলী, আরেক পরাজিত কাউন্সিলর রবিনের তত্ত্বাবধানে বড় বড় বস্তিঘর তুলে দিতেই কয়েক হাজার মানুষ পজেশন কিনে রাতারাতি ঘরবসতি শুরু করে দেন। কিন্তু ওই বস্তি পুড়ে সব হারানো বাসিন্দারা কেউ আর সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাননি। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বস্তির পুরনো বাসিন্দাদের যদি ঠাঁই দেওয়া হয় তাহলে তো নতুন করে পজেশন বিক্রির টাকা আদায় করা যাবে না। কারণ তারা প্রথম দফাতেই মোটা অঙ্কের টাকায় পজেশন কিনে তবেই বস্তিঘর গড়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে মাসিক ভাড়া আর হরেক রকম চাঁদা আদায় ছাড়া এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা সম্ভব হয় না। এ কারণেই রাতারাতি নতুন কারও কাছে বস্তিঘরের জায়গা বুঝিয়ে দিয়ে এককালীন তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করতে পেরেছেন এমপি সমর্থকরা।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় লাগা আগুনে রূপনগর ঝিলপাড় পোড়াবস্তি-সংলগ্ন শিয়ালবাড়ী বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। খবর পেয়ে মাত্র ১৭ মিনিটের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যায় ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। কিন্তু হাজী রজ্জব আলীর বাড়ির পাশ দিয়ে আগুনের উৎসমূলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ৩০-৩৫ জন ষন্ডা প্রকৃতির লোক ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে ভিতরে ঢুকতে বাধা দেয়। তারা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে স্থানীয় নবনির্বাচিত ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী যুবলীগের কয়েকশ কর্মী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নির্বিঘ্নে প্রবেশ করাসহ আগুন নেভানোর কাজে সহায়তা করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আটকে রাখার ঘটনায় পুড়ে ছাই হতে থাকে বেশির ভাগ বস্তিঘর। এই বস্তিতে বসবাস করে ২০ সহস্রাধিক মানুষ। আগুন সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেল পরিবারগুলোকে। এদের ভিতর দেড় হাজার পরিবারের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পোড়া বস্তির সামনে হাজারো মানুষকে কাঁদতে দেখা গেছে। তাদের চোখের জলেও নেভেনি আগুন। এই আগুনে শুধু কান্না আর আহাজারিই ছিল না, সেই সঙ্গে কত রকম যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, তার ইয়ত্তা নেই। আবারও উঠেছে সেই প্রশ্ন- ‘বারবার কেন আগুন লাগে বস্তিতে?’

এর আগে ঝিলপাড়ের চলন্তিকা বস্তিতে যে সময় আগুন লাগে তখন ঈদের ছুটি কাটাতে অনেকেই বস্তিঘর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে সন্ধ্যার পরপর আগুন লাগার ঘটনায় নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঘরবাড়ি। এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, বস্তি খালি করে ‘বড়লোকের’ ভবন বানাতেই আগুন দেওয়া হয়েছে। গণপূর্ত অধিদফতরের জমির ওপর গড়ে ওঠা চলন্তিকা বস্তিটি মিরপুরের সর্ববৃহৎ বস্তি। দীর্ঘদিন ধরেই বস্তির জমি খালি করার চেষ্টা করছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বস্তিবাসীর বাধায় তা সম্ভব হয়নি। আগুনে পোড়ানোর পর সে বস্তির ফাঁকা পড়ে থাকা জায়গার দখল বুঝে নিতেও এগিয়ে যায়নি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ফলে দখলবাজরা আবারও সেখানে ঘরবাড়ি তুলে কয়েক হাজার মানুষকে ভাড়ায় বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে। বিনিময়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

সর্বশেষ খবর