বৃহস্পতিবার, ১২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকে বিশ্বব্যাপী মহামারী ঘোষণা

খারাপ খবর নেই বাংলাদেশে, আক্রান্ত দুজন সুস্থ হচ্ছেন, ২৪ ঘণ্টায় ১০ জনের পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ, ভৈরবে ৩৪ জন হোম কোয়ারেনটাইনে, সিঙ্গাপুরে পাঁচ বাংলাদেশির চারজন সুস্থ

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেল করোনা ভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির প্রধান ডা. টেদ্রোস আধানম ঘেরবাইয়িস গতকাল বলেন, দুই সপ্তাহে চীনের তুলনায় বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ‘উদ্বেগজনক মাত্রায়। আমরা গভীরভাবে  উদ্বিগ্ন’।

কোনো রোগকে মহামারী তখনই বলা হয় যখন তা একাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে ডা. টেদ্রোস বলেন, মহামারী হিসেবে অভিহিত করার অর্থ এই নয় যে     দেশগুলো কী করা উচিত সে সম্পর্কে ডব্লিউএইচওর পরামর্শ পরিবর্তন করছে। তিনি প্রত্যেক সরকারকে ‘জরুরি ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ গ্রহণের মাধ্যমে এই প্রাদুর্ভাবের পথ পরিবর্তন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি দেশ প্রমাণ করেছে এই ভাইরাসটি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’

এদিকে করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো খারাপ খবর নেই বাংলাদেশে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত যে তিনজন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছিল, এদের দুজনই এখন সুস্থ। তাদের যে কোনো সময় হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। তৃতীয়জনের চিকিৎসা চলছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গতকাল দুপুরে এই সুখবরটি দিয়ে বলেন, দেশে নতুন করে কারও মধ্যে কভিড-১৯ ধরা পড়েনি। ২৪ ঘণ্টায় নতুন ১০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল ছিল নেগেটিভ। কিশোরগঞ্জের ভৈরবসহ বিভিন্ন জেলায় বিদেশফেরত শতাধিক ব্যক্তিকে ‘হোম কোয়ারেনটাইনে’ রাখা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির মধ্যে চারজনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাকিজনের অবস্থা অপরিবর্তিত। এদিকে সীমিত সংখ্যক থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের চাপ সামলানো যাচ্ছে না হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিকল হয়ে পড়েছে আরও একটি। তবে সচল দুটি যন্ত্র দিয়েই সব যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্ভব বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। এ ছাড়া সরাসরি তাপমাত্রা দেখতে প্রথমবারের মতো বসানো হয়েছে বড় মনিটর। এদিকে দেহের তাপমাত্রা বেশি থাকায় বিমানবন্দর থেকে ইতালিফেরত যাত্রীকে কোয়ারেনটাইনে পাঠানো হয়েছে। হেলথ স্ক্রিনিংয়ের জন্য জনবলও বৃদ্ধি করা হচ্ছে।

গত রবিবার দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করে আইইডিসিআর। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ সম্প্রতি ইতালির দুটি শহর থেকে দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে একজনের সংস্পর্শে এসে পরিবারের আরেক নারী সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার পর এদের মধ্যে দুজন সুস্থ হয়েছেন। বুধবার আইইডিসিআরের সম্মেলন কক্ষে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা দ্বিতীয় দফায় যে পরীক্ষা করেছি, তাতে তিনজনের মধ্যে দুজনের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। আপনারা জানেন যে পর পর দুবার নেগেটিভ এলে আমরা তাদের ডিসচার্জ করে দিতে পারি। তো তিনজনের মধ্যে দুজন অলরেডি নেগেটিভ। তিনি বলেন, আমরা আগেও বলেছি, শারীরিকভাবে তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা ছিল না। তারা সুস্থ আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে প্রটোকল, সে অনুযায়ী আমরা তাদের রিলিজ করে দেব। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে মোট আটজনকে ‘আইসোলেশনে’ রাখা হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, আইইডিসিআরের হটলাইনে তারা গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ২২৫টি কল পেয়েছেন, তার মধ্যে ৩ হাজার ১৪৫টি কল ছিল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত। এই সময়ে মোট ২৪ জন আইইডিসিআরে গিয়ে সেবা নিয়েছেন এবং মোট ১০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৪২টি নমুনা পরীক্ষা করে ওই তিনজন ছাড়া আর কারও মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস ধরা পড়েনি। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরে পাঁচজন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইতালিতে এর আগে দুজনের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল। তাদের মধ্যে সিঙ্গাপুরের চারজন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন জানিয়ে ডা. ফ্লোরা বলেন, যার অবস্থা ক্রিটিকাল ছিল, তা অপরিবর্তিত রয়েছে।

আট জেলায় ‘হোম কোয়ারেনটাইনে’ ১৩৭ জন : বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের দেহে করোনাভাইরাস আছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য ‘হোম কোয়ারেনটাইন’ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত শতাধিক লোককে এই ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে কেউ এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বিদেশফেরত ৩৭ জনকে হোম কোয়ারেনটাইনে রাখা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ইতালি থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। এ ছাড়াও সৌদি আরব, জর্ডান ও সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসা কয়েকজন রয়েছেন। এই ৩৭ জন গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন সময়ে দেশে এসেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মুজিবর রহমান। তিনি জানান, ‘ইতিমধ্যে ৩৭ জনের তথ্য জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। তবে ৩৭ জনের মধ্যে কাররই করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদেশফেরত সবাইকে ১৪ দিন হোম কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে। তাদের সবাইকে নিজ নিজ বাসায় একটি কক্ষে সম্পূর্ণ আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের বাসায় গিয়ে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছেন। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো কিছু নেই। এর আগেও আমরা কিশোরগঞ্জের কয়েকটি উপজেলায় বিদেশফেরত আরও কয়েকজনকে হোম কোয়ারেনটাইনে রেখেছিলাম। এখন পর্যন্ত একজনেরও কোভিড-১৯-এর লক্ষণ বা আক্রান্তের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া মানিকগঞ্জে ৭৯ জন, যশোরে ছয়জন, কেরানীগঞ্জে পাঁচজন, নারায়ণগঞ্জে পাঁচজন, বগুড়ায় দুজন, নরসিংদীতে দুজন, খুলনায় একজন এবং ফেনীতে নয়জনকে হোম কোয়ারেনটাইনে রাখা হয়েছে। মোংলা বন্দরে অবস্থানরত মার্শাল আইল্যান্ড পতাকাবাহী এমভি ‘এমভি সেরিনিটাস এন’ জাহাজে ফিলিপাইনের তিন নাবিক করোনাভাইরাস মুক্ত বলে রিপোর্ট দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পোর্ট হেলথ বিভাগ। এরপরে গতকাল ভোর থেকে ওই জাহাজের কয়লা খালাস শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মোংলা পোর্ট হেলথ কর্মকর্তা ডা. সুফিয়া খাতুন জানান, মোংলা বন্দরে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজের (ফিলিপাইনের) তিন নাবিককে এক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ফলোআপ চেকআপ করেছেন মেডিকেল টিম। এখন তাদের শরীর পুরোপুরি সুস্থ আছে।

শাহজালালে জনবল বৃদ্ধি হচ্ছে : ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার আগে প্রত্যেক যাত্রীকে থার্মাল স্ক্যানার কিংবা হ্যান্ডহেল্ড ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপার পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে হেলথ কার্ড ও হেলথ ডিক্লারেশন ফরম পূরণ করে জমা দিতে হচ্ছে। যাত্রীদের অভিযোগ ফ্লাইটে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে বিমানবন্দরে নামার পর তাদের হেলথ স্ক্রিনিংয়ের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। তবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের নিয়মিত হেলথ স্ক্রিনিংয়ের চাপ কমাতে জনবল বৃদ্ধি করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দ্রুত জনবল বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনের উহান সিটিতে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার পর চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের হেলথ স্ক্রিনিং শুরু হয়। শুরুর দিকে শুধু চীনফেরত যাত্রীদের হেলথ স্ক্রিনিং করা হলেও পরবর্তীতে সব ফ্লাইটের যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু হয়।

শুরুর দিকে অল্প কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স থাকলেও পরবর্তীতে জনবল বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২২ জন ডাক্তার, ১০ জন নার্স, ১৮ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, চারজন অফিস সহায়ক ও তিনজন ড্রাইভার রয়েছে। ডাক্তার ও নার্সসহ ৫৫ জন জনবল কাজ করলেও প্রতিদিন অন্তত পাঁচ হাজার যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয় তাদের। এত যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার চাপ সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

একই বৈঠকে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে ডাক্তার ও নার্সসহ জনবল বৃদ্ধির দাবি ওঠে। সভায় উপস্থিত স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা দু-এক দিনের মধ্যে আরও জনবল নিয়োগ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

সর্বশেষ খবর