শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আতঙ্কে সংকটে প্রবাসীরা

দলে দলে ফিরতে চান দেশে, এলে হন বিব্রত, ছুটি শেষ হয় কোয়ারেন্টাইনেই ফিরে কাজে যোগ দেওয়াও অনিশ্চয়তায়, রেমিট্যান্সে পড়তে পারে প্রভাব

জুলকার নাইন

করোনাভাইরাস আতঙ্ক চতুর্মুখী সংকটে ফেলেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু হয়ে পূর্ব এশিয়া- সর্বত্রই গৃহবন্দী হয়ে রয়েছে প্রায় ১ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি। একদিকে প্রাণঘাতী রোগের ভয়ে পরিবার নিয়ে থাকতে হচ্ছে শঙ্কায়, অন্যদিকে আয়-রোজগার বন্ধের পথে। দিন বা সপ্তাহভিত্তিক চাকরি করা প্রবাসীরা পড়েছে সংকটে। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে স্বল্পসময়ের জন্য দেশে ফিরলেও বিব্রত হতে হচ্ছে। অনেকের ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে কোয়ারেন্টাইনেই। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের অনেককে করোনামুক্ত সার্টিফিকেট পেতে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। আবার আশ্বাস পেলেও ছুটির দিনক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর কর্মস্থলে ফিরে কাজে যোগ দেওয়া নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। আসলেই সেসব দেশে ফের ঢুকতে পারবেন কিনা, এ নিয়েই ভীত শ্রমিকরা। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের এখন প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশে না আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রবাসীদের এ সংকট প্রভাব ফেলতে পারে রেমিট্যান্স প্রবাহে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘বিভিন্ন দেশে আমাদের ১ কোটি ২২ লাখ প্রবাসী থাকেন। তাদের বলেছি, একটু ধীরে আসুন। যারা যে দেশে আছেন, সে দেশেই থাকুন। সে দেশের আইনকানুন মানুন। কোনো কিছুর দরকার হলে দূতাবাসে যোগাযোগ করুন। দূতাবাস আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।’ জানা যায়, স্পেনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আট বাংলাদেশি। এর মধ্যে তিনজনের বাড়ি সিলেটে। তাদের একজনের বয়স ৪৫, আরেকজনের ৪৩ এবং অন্যজন নারী, তার বয়স ৩৫ বছর। তারা দেশটির রাজধানী মাদ্রিদের বাঙালি-অধ্যুষিত লাভাপিয়েসে থাকেন। বাকিদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা দুজন। তারা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে রাখা হয়েছে। স্বামীর বয়স ৩৭ ও স্ত্রীর ২৬। তাদের দুই মাসের একটি শিশু সন্তানকে হাসপাতালের হেফাজতে রাখা হয়েছে। তারা মাদ্রিদের অদূরে কারাবানচলে থাকেন। করোনায় আক্রান্ত অন্য দুজনই তরুণ। এর মধ্যে ২৫ বছর বয়সী একজনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। অন্যজনের ঠিকানা জানা যায়নি। তারা দুজনই রাজধানী মাদ্রিদে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। স্পেনজুড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় ইতিমধ্যে মাদ্রিদ, বার্সেলোনাসহ বেশ কয়েকটি প্রদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অফিস-আদালত বন্ধ করা হয়েছে। যানবাহন ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে আনতে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগের যে, বাংলাদেশি-অধ্যুষিত লাভাপিয়েসের বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশ মসজিদে গতকাল জুমার নামাজও হয়নি। এদিকে দিন যত যাচ্ছে ফ্রান্সে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে আতঙ্কে রয়েছে সে দেশে থাকা বাংলাদেশিরাও। আতঙ্কের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকায় সবাইকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সেখানে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেন। স্বাস্থ্যবিধি মানার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সবাই সচেতন আছেন। রাষ্ট্র সচেতন আছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সবাই একসঙ্গে কাজ করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।’ কিন্তু আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। ফ্রান্স বাংলাদেশ ইকোনমিক চেম্বারসের সভাপতি কাজী এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা পণ্যের সরবরাহ পাচ্ছি না। আমাদের ক্রেতাও আসছে না। ফলে আমরা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় ২ নম্বরে থাকা ইতালি পুরোপুরি অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। ফলে ইতালিপ্রবাসী বাংলাদেশিরা শুধু আতঙ্কেই নন, তারা চাকরিও হারাচ্ছেন। এ মুহূর্তে ২ লাখ ৬০ হাজারের মতো বাংলাদেশি ইতালিতে রয়েছেন। দেশটির বেশির ভাগ শহরে জনকোলাহল থেমে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় তালা ঝুলছে। সুপার শপ, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাবের বেশির ভাগই বন্ধ। সিনেমা হল, জাদুঘরও বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চরম সংকটে পড়েছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। সচেতনভাবে চলতে প্রবাসীদের পরামর্শ দিয়ে ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার বলেছেন, ‘সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। আইন মেনে চলতে হবে নিরাপত্তার জন্য।’ করোনাভাইরাসের প্রভাব ঠেকাতে বুধবার থেকে পর্তুগালের বেশির ভাগ অংশের জিম, গ্রন্থাগার, সিনেমা হল বন্ধ রাখাসহ দেশটির সব স্কুল-কলেজ আগামী ৯ এপ্রিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে পর্তুগালে পর্যটকদের যাতায়াত। কিন্তু সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশির অধিকাংশই পর্যটননির্ভর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা পড়েছেন হুমকিতে।

সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির মধ্যে তিনজন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এখন চিকিৎসাধীন রয়েছেন দুজন। তাদের অবস্থাও স্থিতিশীল। যে কোনো সময় তারাও হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাবেন। ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশত্যাগ না করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। যদিও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আসা তিন সদস্যের এক পরিবারের স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানতে সিঙ্গাপুর সরকারই খোঁজখবর রাখছে। জাপানে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সভা-সমাবেশ এড়িয়ে চলার অনুরোধ জানিয়েছে টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাস। এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে দূতাবাস বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে জাপান সরকার বড় আকারের (১০০ জনের বেশি) সমাবেশ না করতে সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে। জাপান সরকারের অনুরোধের প্রতি সম্মান জানিয়ে সবাইকে বড় আকারের সভা-সমাবেশ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস।

কোরিয়ায় থাকা বাংলাদেশিদের প্রত্যেকে অতিপ্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে যাচ্ছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইলে সতর্কতামূলক মেসেজ পাঠানো হয়েছে। ফ্যাক্টরি মালিকদের পক্ষ থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মাস্ক ব্যবহার করতে, জনসমাগম বেশি হয় এমন জায়গা, পাবলিক ট্রেন, বাস, শপিং মল ইত্যাদি পরিহার করতে। সেখানকার এক প্রবাসী কর্মী জোয়ার্দার জানান, ফ্যাক্টরির দুজন বাংলাদেশি এ মাসের প্রথম সপ্তাহে চীন ভ্রমণ করে এসেছেন। আতঙ্কের কারণে তাদেরও আলাদা কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস রোধে সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করলেও সেখানেও ছড়িয়েছে ভাইরাস। ফলে স্থানীয়দের মতো করোনা নিয়ে আতঙ্কে আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। এরই মধ্যে ওমরাহ ও ভ্রমণ ভিসা স্থগিত করেছে সৌদি সরকার। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যও পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত ওমরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় স্থবিরতা নেমে এসেছে সেখানকার জনজীবনে। ফলে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় সৌদি আরবে বসবাসকারী যারা ছুটি নিয়ে দেশে অবস্থান করছেন, তাদের নিজ দেশে আসা-যাওয়া নিয়ে কোনো বাধা নেই। তবে ওই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত কোনো দেশে ভ্রমণ করলে অবশ্যই তা জানাতে হবে। একই সঙ্গে মেডিকেল রিপোর্ট সঙ্গে রাখতে হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সৌদি প্রবাসীদের একটি বড় অংশ গলফ এয়ার, এমিরেটসসহ বিভিন্ন ফ্লাইটের টিকিট কিনে পড়েছেন বিপাকে। এসব ফ্লাইটে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে ট্রানজিট নিলেই আর সৌদি আরবে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফিরতে হচ্ছে দেশে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এক বাংলাদেশি প্রবাসী। তার নাম প্রকাশ করা না হলেও তিনি ৩৯ বছর বয়সী বলে জানা গেছে। সেখানেও চাকরি ও ব্যবসা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কাতারে বাংলাদেশিদের প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেছে।

কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম বলেছেন, ‘এ পর্যন্ত কোনো প্রবাসী বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হননি। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছেন আতঙ্কে। তবে তারা সচেতনতা বজায় রাখছেন। কুয়েত দূতাবাস সব সময় প্রস্তুত আছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সহযেগিতার জন্য। আমাদের সঙ্গে কেউ যে কোনো সময় যোগাযোগ করলে আমরা তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করব।’

যুক্তরাষ্ট্রেও করোনাভাইরাসে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। শুধু নিউইয়র্কেই আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ৪ হাজার মানুষকে। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সংকটের ভয়ে অনেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখছেন। ক্রেতাভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দোকানিরা। প্রবাসীরা বলছেন, ‘বাজার করছি, কারণ কিছুদিন পর দোকান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’

দেশে ফিরে বিব্রত ও ভোগান্তি : দেশে ফিরে আসার পর প্রবাসীর একটি বড় অংশই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে। দেশে ফেরার পর কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলছে না, দেখা করছে না। আবার অনেককে জোর করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। পরে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে করোনামুক্ত সার্টিফিকেট নিতেও পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। প্রবাসী আবু তাহের বলেন, ‘২০ বছর ধরে সৌদি আরবে চাকরি করি। মাসখানেক আগে ছুটিতে এসেছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ সনদ ছাড়া এখন যেতে পারছি না। ওই দেশ থেকে বলা হয়েছে, সনদ না নিয়ে এলে বিমানবন্দর থেকেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাই করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ সনদ ছাড়া বিমানে ওঠা বোকামিই হবে। এমন জরুরি প্রয়োজনেও আইইডিসিআরের নিরাপত্তারক্ষীরা ভবনের ভিতরেই আমাদের ঢুকতে দিচ্ছেন না। কবে নাগাদ সনদ পাব বা সনদ পেতে কী করণীয় সবকিছুই অন্ধকার লাগছে। এখানে আমাদের অনেকের অবস্থা আমার মতোই।’ আরেক প্রবাসী বুলবুল বলেন, ‘বিরাট সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা। আমাদের শরীরে করোনাভাইরাস নেই, তা প্রমাণ করতেই ঘাম ঝরছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করা উচিত। আর কয়েক দিন পর আমার ফ্লাইট। এর মধ্যে সনদ জোগাড় না করতে পারলে ভাইরাসে নয়, এমনিতেই মাঠে মারা পড়ব।’

সর্বশেষ খবর