শিরোনাম
শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

তারুণ্যের বিকাশে আইসিটি বিপ্লব

হবে প্রধান রপ্তানি আয়ের খাত, পাঁচ বছরে ১০ লক্ষাধিক আইটি পেশাদার তৈরির উদ্যোগ

সাঈদুর রহমান রিমন

তারুণ্যের বিকাশে আইসিটি বিপ্লব

বাংলাদেশেই তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বমানের প্রযুক্তিপণ্য স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ। দেশে নির্মিত সফটওয়্যার দিয়েই চলবে দেশের ব্যাংক, বীমা, কল-কারখানা, অফিস-আদালত। সবকিছুর দ্বার খুলতে প্রস্তুত হচ্ছে প্রযুক্তিপণ্যের শিল্পাঞ্চল হাইটেক পার্ক। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি (বিএইচটিপিএ) সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে তারা কালিয়াকৈরে ২৩২ একর জমিতে প্রথম হাইটেক পার্ক (বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি) নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর বাইরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার খরিতাজুড়ি বিলে দেশের দ্বিতীয় হাইটেক পার্ক স্থাপনের জন্য ১৬৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীর কারওয়ান বাজারের জনতা টওয়ার, যশোর, রাজশাহীসহ দেশের সাতটি বিভাগে ১২ জেলায় সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। হাইটেক পার্কগুলো সচল হলেই আইসিটি সেক্টর জাতীয় রাজস্ব আয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে বলে আশা করছে সরকার। অন্যদিকে এ সেক্টরে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এক দশকের মধ্যে আইসিটি হবে দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের খাত। ইতিমধ্যে হাইটেক পার্কের উন্নয়নে এবং বিনিয়োগের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক চারটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ হাইটেক পার্কের তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্যদিকে জাপানও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। জাপানের রাষ্ট্রদূত মাশাতো ওয়াতানাবে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছেন, এ দেশের বিভিন্ন হাইটেক পার্কসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করতে চায় জাপান। এ ছাড়া হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিনিয়োগে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চায়না বেটার বিজনেস ব্যুরো (চায়না বিবিবি)। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অভাবনীয় অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বস্বীকৃত। বিশ্বের শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজারে বিনিয়োগ করছে। বর্তমানে টেলিকম বাদেই বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বাজার প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের। সরকার ২০২১ সাল নাগাদ এ খাতের রপ্তানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশের সম্ভাবনাময় আরেক খাত হলো ই-কমার্স। এ খাতে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বাজার তৈরি হয়েছে। ই-লেনদেনে প্রতি মাসে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ব্যবহারকারী এবং প্রায় ছয় কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর এ দেশে ই-বাণিজ্য জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। অংশগ্রহণ থাকছে আউটসোর্সিং খাতেও। বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের (বিপিও) বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে বাংলাদেশি তরুণ আইটি পেশাদারদের অংশগ্রহণ দিন দিনই বাড়ছে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল গেইমিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে শুরু করে আইটি সেক্টর, ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং- সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে।

দেশেই তৈরি হবে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ : এখন দেশেই স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ প্রভৃতি প্রযুক্তি উৎপাদন করাতে চায় সরকার। ভবিষ্যতে তা রপ্তানিও করতে চায় বাংলাদেশ। সরকারি হিসাব মতে, প্রতি বছর পাঁচ লাখের বেশি ল্যাপটপ ও তিন কোটির বেশি মোবাইল ফোন আমদানি হচ্ছে। বিরাট এ বাজারকে টার্গেট করে এরই মধ্যে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ শ্রীলঙ্কান এক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ওই কোম্পানি এ দেশে তাদের কারখানা স্থাপন করে ল্যাপটপ, ট্যাব ও স্মার্টফোন তৈরি করবে। স্বল্পমূল্যে সেসব পণ্য দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অন্যান্য দেশে রপ্তানিরও পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে তথ্যপ্রযুক্তির সব ক্ষেত্রেই দেশে রীতিমতো বিপ্লব চলছে। প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, পড়াশোনা, কেনাকাটা, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা, অফিস-আদালতের কাজকর্ম, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে, যার সুফল পেতে শুরু করেছে মানুষ।

চলতি বছর ২০ লাখ পেশাজীবী তৈরি : তথ্যপ্রযুক্তি হবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত। এ খাত থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। একই সময়ে ২০ লাখের বেশি তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরি করা হবে। এ জন্য সারা দেশে কানেকটিভিটি তৈরি করা হয়েছে। দেশের গ্রামাঞ্চল থেকেও যেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা কাজ করতে পারেন এমন অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজ চলছে। ১৯৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কালিয়াকৈরে নির্মাণ করা হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ডাটা সেন্টার। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম এই ডাটা সেন্টারে ব্যাংক, গবেষণা কেন্দ্র, সরকার এবং অন্যান্য বাণিজ্য সংস্থার গোপনীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য সংরক্ষিত হবে। কেবল দেশের তথ্য সংরক্ষণই নয়, বিদেশি বাণিজ্য সংস্থা ও অন্য দেশগুলোর তথ্য সংরক্ষণেরও অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ডাটা সেন্টার।

সর্বশেষ বাস্তবতা : বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ সেন্টার ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনবল তৈরি করা হচ্ছে। হাইটেক পার্কগুলোর মাধ্যমে শিগগিরই ৫০০ কোটি ডলার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সফটওয়্যার ও সেবা রপ্তানি করবে বাংলাদেশ। এযাবৎ টেকনো সিটির ২ লাখ বর্গফুটবিশিষ্ট আটতলা ভবনের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে ২৬টি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে তারা ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, পিসি ও বিভিন্ন এক্সেসরিজ তৈরি বা সংযোজন করবে। প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে কর্মসংস্থান হবে প্রায় এক লাখ তরুণ-তরুণীর।

 বর্তমানে এ পার্ক থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আইটি পণ্য রপ্তানি শুরু করেছে। হাইটেক পার্কের তথ্য অনুযায়ী, তাদের তিনটি পার্ক, বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি এবং ১৩টি বেসরকারি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে এ পর্যন্ত ৮ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৪ হাজার ৪৭৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ৩ হাজার ১০০ জনের প্রশিক্ষণ চলমান এবং আরও ৪৫ হাজার জনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ৬৬টি প্রতিষ্ঠানকে সার্টিফিকেশনের জন্য সহায়তা দিয়েছে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি।

আউটসোর্সিংয়ে বিশ্বে তৃতীয় : জানা গেছে, বর্তমানে আউটসোর্সিংয়ের জন্য ভালো এমন ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। যেসব কোম্পানি আউটসোর্সিংয়ের জন্য লোক খোঁজে, তারা বাংলাদেশকে তাদের অন্যতম পছন্দের তালিকায় রাখছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ ভাগের বয়স পঁচিশের নিচে। তাই তরুণরা ভালোভাবে প্রশিক্ষণ পেলে আউটসোর্সিং থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারবে। ইতিমধ্যে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। আউটসোর্সিংয়ে করা আয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থান দখল করে আছে।

পদ্মাপাড়েই ১৪ হাজার কর্মসংস্থান, যশোরেও শুরু : কর্মসংস্থানের অভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো যুগ যুগ ধরেই ছিল অবহেলিত, ছিল বেকারদের ছড়াছড়ি। শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রতি বছর কার্তিকের মঙ্গায় লাখ লাখ মানুষ উত্তরের জনপদ ছেড়ে রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায় পাড়ি জমাত। কঠিন কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে অমানবিক জীবনধারণ করা যেন উত্তরাঞ্চলবাসীর কপালের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাক্সিক্ষত কল-কারখানা, বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে ওঠেনি সেখানে। তবু বিরাটসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টির হাতছানিতে উচ্ছ্বাস-আনন্দের জোয়ার বইছে। এদিকে যশোরের হাইটেক পার্ক ইতিমধ্যে পুরোপুরি চালু হয়েছে। সেখানে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২৫টি প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি কাজ শুরু করেছে। স্থানীয় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানও আছে ১৫টি। বাকিগুলো ঢাকাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শাখা। সেখানে জায়গা বরাদ্দ পেলেও অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাজ শুরু করেনি। এসব প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করলে কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

পোশাক খাতকে ছাড়াবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় : রপ্তানি আয়ে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। ২০২১ সালের আগেই দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের পোশাক খাতকে পেছনে ফেলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা। ২০২১ সালে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের এই লক্ষ্যমাত্রার ৪৫ বিলিয়নই চলে যাবে মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি করতে। সে হিসাবে মূল রপ্তানি আয় দাঁড়াবে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২১ সালে সফটওয়্যার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এ জন্য কোনো কাঁচামাল আমদানি করতে হবে না। ব্যয় হবে শুধু মেধা। আর ২০২১ সালের আগেই এই পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি ছাড়াবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার।

সর্বশেষ খবর