রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

এক দৌড়ে এগারোয়

সমরেশ মজুমদার

এক দৌড়ে এগারোয়

একে চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ, তিনে নেত্র...। এইভাবে শুরু করেছিলাম বছর গোনা। শৈশবে সবাই যেমন করে থাকে। কিন্তু মুশকিল হয়েছিল ওই তিনে নেত্র মুখস্থ করার সময়। নেত্র মানে চোখ। তাহলে তিনটে চোখের কথা বলা হয়েছে কেন? আমার চারপাশের সব মানুষের এখন বাড়ির পোষা প্রাণী বা পাখিদেরও দুটো চোখ। তাহলে তৃতীয় নেত্রটি পেল কোথায়? এক সহপাঠী সেই সাড়ে তিন বছর বয়সে বুঝিয়েছিল, তৃতীয় নয়ন বা নেত্র রয়েছে কপালের ঠিক মাঝখানে, দুই ভ্রুর কাছাকাছি। সেই বয়সে অনেক চেষ্টা করেছি দেখার। আমার এক সহপাঠী তো ঘষে ঘষে কপালে ক্ষত তৈরি করে ফেলেছিল কিন্তু তৃতীয় নয়নের দর্শন পায়নি। আমাদের বাংলার স্যার বলেছিলেন, সবার তৃতীয় নয়ন তৈরি হয় না, কারও কারও হয়। সেই তৃতীয় নয়নে শুধু তারাই দেখতে পান? কী দ্যাখেন? না, যা সাধারণ চোখে দ্যাখা যায় না।

তা তো হলো। একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে যখন দশে এসে দশ দিক উন্মোচিত হলো তখন কপালে আঙ্গুল বুলিয়ে বুঝলাম, নেত্র জেগে ওঠেনি। দশ পেরিয়ে যখন এগারোর দিকে পা বাড়াচ্ছি তখন সকাল বেলায় কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে গেল তখন অলস চোখে দেখতে গিয়ে যেন মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ জানান দিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন সামনে মেলে ধরে আবিষ্কারের আনন্দে পুলকিত হলাম, এই তো আমার তৃতীয় নয়ন। জন্মসূত্রে যে দুই নয়নের দৃষ্টি যেখানে থমকে যায়, এই তৃতীয় নয়ন তার পরের ভুবনটাকে প্রাণভরে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রতিটি সকালে।

হ্যাঁ, সংবাদপত্র আমাদের তৃতীয় নয়ন, যে নয়ন সুদূরপ্রসারী, যে নয়ন সময়বিশেষে অন্তর্মুখী। এক থেকে দশে গড়গড়িয়ে পৌঁছাতে যেসব বিপত্তির সামনে পড়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন তা স্বচ্ছন্দে অতিক্রম করে যখন একাদশে পা দিচ্ছে তখন আর বুঝতে অসুবিধে হয় না তার শিরদাঁড়ায় জোর আছে। খবরের কাগজের শিরদাঁড়া অথবা মেরুদন্ড কী? এক কথায় বললে বলতে হয় সংবাদ পরিবেশনে সততা বজায় রাখা। প্রতিদিন যা ঘটছে তাই পাঠকদের সামনে তুলে ধরাই হলো সৎ সংবাদপত্রের অন্যতম কাজ। সেই ঘটনাগুলো ইচ্ছেমতো কাটছাঁট করে, সামান্য রং চড়িয়ে বা কমিয়ে পরিবেশন করলে হয়তো সাময়িক সাড়া পাওয়া যায় কিন্তু বালুর ওপর তৈরি সেই অট্টালিকা ভেঙে পড়ে যে কোনো মুহূর্তে। বাস্তবের ফটোগ্রাফি আর শিল্পীর তুলির টানে আঁকা সেই বাস্তবের ছবির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য থাকে। সঠিক বাস্তব আর কল্পিত বাস্তবের সংঘর্ষে দ্বিতীয়টির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

সময় বদলাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে বাংলা সাহিত্য থেকে সাধুভাষা বিদায় নিয়েছে বলাই সঙ্গত। এখন কেউ সাধুভাষায় আধুনিক উপন্যাস লেখেন না। পাঠকও তা পড়তে চান না। কিন্তু বিষয় যদি ঐতিহাসিক হয় তাহলে ভাষায় প্রাচীনত্ব পাঠক উপভোগ করেন। কথ্য ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করতে করতে অনেকেই অসচেতনভাবে এমন বাক্য ব্যবহার করেন যা পাঠক তার জীবনে বাতিল করেছেন। এই শব্দগুলো খবর পড়তে গিয়ে পড়লে পাঠক হোঁচট খান বিরক্তবোধ করেন। এখনো এই দুই হাজার কুড়িতে খবরের কাগজ ওই শব্দদূষণ থেকে মুক্ত হলো না।

কিন্তু এক দুই করে দশ দিক উন্মোচিত করে দশ বছর পেরিয়ে যেতে যেতে বাংলাদেশ প্রতিদিন শুধু সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেই নয়, সেই সংবাদ যে ভাষায় পরিবেশন করা হচ্ছে তার সম্পর্কেও যথেষ্ট সতর্ক হয়েছে। ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে যাওয়ার পথে চায়ের দোকানে বাংলাদেশ প্রতিদিনে মুখ ডুবিয়ে থাকা পাঠকদের প্রশ্ন করে জেনেছি, সকাল বেলায় ওই কাগজ না পড়লে দিনটা খুব খারাপভাবে তাদের কাটে। দশ বছরে পাঠকের মনে এই জায়গাটা তৈরি করে নিতে পেরেছেন প্রিয় সম্পাদক নঈম নিজাম এবং তার সহযোদ্ধারা।

মানুষ এগারোতে পা দিলে তার নাবালকত্ব দূর হয়। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন এখন তারুণ্যে টগবগ করছে। লেখক : বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর