রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে অভিনন্দন

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে অভিনন্দন

সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এবারে নিয়ে টানা ১০ বছর সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সামাজিক যোগাযোগের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের কারণে এমনিতেই সারা পৃথিবীতে কাগজে ছাপা সংবাদপত্রের প্রাণ নিবু নিবু, এর মাঝে একটি পত্রিকা দীর্ঘদিন টিকে থাকাই অনেক বড় ব্যাপার। কাজেই বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে কোনো একটা বিচিত্র কারণে জাতীয় এবং আঞ্চলিক সংবাদপত্রের সংখ্যা অগুনিত সেখানে টানা ১০ বছর সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র হওয়ার গৌরবটি বিশাল একটি অর্জন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। যে কোনো অর্জনের সঙ্গে একটি দায়িত্ব চলে আসে। অর্জনটি যদি বড় হয় তাহলে দায়িত্বটিও হয় বড়। কাজেই বাংলাদেশ প্রতিদিনেরও একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। তারা যেহেতু তাদের বিশাল পাঠকের মনোজগৎটি স্পর্শ করতে পারছেন কাজেই তাদের সংবাদপত্রটি খুব সতর্কতার সঙ্গে পাঠকদের মনোজগতের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় রগরগে উত্তেজক কিংবা স্পর্শকাতর সংবাদ পাঠকদের কৌতূহল। তাই সংবাদপত্রগুলো সজ্ঞানে কিংবা নিজের অজান্তেই তাদের সংবাদপত্রে এ ধরনের পাঠকপ্রিয় সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করে। একবার দায়িত্বশীল হয়ে যাওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি যে কোনো সংবাদপত্র থেকে দ্রুত এবং অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে আধা সত্য কিংবা ভয়াবহ রকম স্পর্শকাতর সংবাদ পরিবেশন করতে পারে। শুধু তাই নয়, সেটিকে তারা এত দ্রুত ছড়াতে পারে যে তার জন্য ‘ভাইরাল’ নামে একটা আলাদা শব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। কাজেই তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা সংবাদপত্রের কাছে চাইব বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি খবর আমার কাছে চলে এলেও আমি অপেক্ষা করি সংবাদপত্র দিয়ে তার সত্যতা যাচাই করে নেওয়ার জন্য। কাজেই আমি বিশ্বাস করি, সংবাদপত্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধরে রাখা। একই সঙ্গে আমি তাদের কাছে এক ধরনের পরিমিতিবোধ প্রত্যাশা করি। যে কোনো মানুষ নেতিবাচক খবরে একটু বেশি কৌতূহলী হয়, তাই সংবাদপত্রে তাদের পরিমাণ থাকে তুলনামূলকভাবে বেশি। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবীতেই এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই এখন দেখার বিষয়, সংবাদপত্রগুলো অহেতুক অকারণ আতঙ্ক না ছড়িয়ে কত দক্ষতার সঙ্গে সতর্কতার বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, আত্মহত্যার খবরগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর। একটি আত্মহত্যার খবর প্রচারিত হলে আত্মহত্যাপ্রবণ অনেক কম বয়সী তরুণ-তরুণী নিজ থেকে আত্মহননের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাজেই সত্যিকারের খবর হওয়ার পরও কোন খবরটি উচ্চ স্বরে প্রকাশ করতে না হয় সে ব্যাপারেও সংবাদপত্রগুলোকে নিজেদের দায়িত্ববোধ এবং পরিমিতিবোধ দেখাতে হবে। নিরপেক্ষ বলে বাংলা ভাষায় একটা নিরীহ এবং ইতিবাচক শব্দ আছে, আমি যে শব্দটাকে যথেষ্ট ভয় পাই। কারণ আমি অনেক সংবাদমাধ্যমকে দেখেছি, যারা ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝখানে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে। আমাদের অনেক বড় দুর্ভাগ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাস করে না সে রকম রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। তাই যখন সংবাদমাধ্যমকে দেখি নিরাপত্তার আবরণে তাদের জনসমক্ষে তুলে আনা হচ্ছে, আমি দুর্ভাবনা অনুভব করি। অবশ্যই আমরা সংবাদমাধ্যমের কাছে নিরপেক্ষতা আশা করি, কিন্তু সেটি ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝে নয়, সত্য এবং মিথ্যার মাঝে নয়, সাদা এবং কালোর মাঝে নয়, ঠিক কোথায় কীভাবে সেই রেখাটি টানতে হবে সেই দায়িত্বটি সংবাদমাধ্যমের। আমরা আশা করব, বাংলাদেশ প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র হিসেবে এ ব্যাপারে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করি। আশা করি তারা এই দেশের মানুষের জন্য একটি সাহসী এবং দায়িত্বশীল সংবাদপত্রের ভূমিকা রাখবে। লেখক : শিক্ষাবিদ

সর্বশেষ খবর