রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মুজিববর্ষে শুভেচ্ছা বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

মুজিববর্ষে শুভেচ্ছা বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ দশ বছর পার করে এগারোতে পা দিল। মানুষ হলে বলতাম বয়ঃপ্রাপ্তি ঘটল। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিনের বেলায় এটা বলা চলে না। এটি সংবাদপত্র। এবং দেখা গেছে, জন্মের পর থেকেই পত্রিকাটি বয়ঃপ্রাপ্তির প্রমাণ দেখিয়েছে। পাঠকপ্রিয় হয়েছে। শুনেছি প্রচারসংখ্যায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হওয়ার দাবিদার পত্রিকার প্রচারসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে সে। আমি যখন লন্ডনে আসি, সেই চল্লিশ বছর আগের কথা। তখন অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকই ছিল ব্রডশিট। ট্যাবলয়েড কাগজগুলোকে আমি অবজ্ঞা করতাম। এখন দেখছি যুগটা পাল্টে গেছে। জাতীয় দৈনিকগুলোও ধীরে ধীরে ট্যাবলয়েডে পরিণত হচ্ছে। এত বিরাট প্রচারসংখ্যার প্রাচীন কাগজ ডেইলি মেইল ট্যাবলয়েড কাগজ হয়ে গেছে। ট্যাবলয়েড হয়েছে গার্ডিয়ানও। টাইমস ব্রডশিটের সঙ্গে ট্যাবলয়েড সংস্করণ বের করেছে। আগে লন্ডনের ট্যাবলয়েড দৈনিকগুলোকে বলা হতো ওয়ার্কিং ক্লাসের পাঠকের কাগজ। এখন আর তা বলা হয় না। প্রচারসংখ্যায় ব্রডশিট দৈনিক ট্যাবলয়েডের কাছাকাছিও যেতে পারে না। একই গ্রুপের দৈনিক টাইমস এবং সান। টাইমসের প্রচারসংখ্যা সাত-আট লাখের মতো। সানের প্রচারসংখ্যা ষাট লাখের মতো। ঢাকার বাংলাদেশ প্রতিদিন কাগজটির বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা রাজপথের মানুষের কাগজ। আবার অভিজাত পাঠকের ঘরে থাকার মতো কাগজও। সে দশ বছর পার করেছে। আরও দীর্ঘকাল পাঠকপ্রিয় হয়ে বেঁচে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন একটু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এবার মুজিববর্ষে পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপিতা এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে চিনি। কিন্তু তিনি যে সাংবাদিকতা করেছেন, সংবাদপত্র চালিয়েছেন, সে খবর আমরা অনেকেই রাখি না। ছয় দফার আন্দোলনের আগেও বঙ্গবন্ধু ‘দুই অর্থনীতির’ একটা আন্দোলন শুরু করেছিলেন পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। এ আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের দুই অংশে দুই অর্থনীতি প্রবর্তনের। যেহেতু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেজন্য দেশের দুই অংশে তিনি দুই অর্থনীতি প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁর ওই দাবিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী সমর্থন জানিয়েছিলেন।

এ আন্দোলনের প্রচার চালানোর জন্য বঙ্গবন্ধু (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) ‘নতুন দিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। তিনি নিজেই ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক এবং নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন কবি জুলফিকার। তিনি রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলেন। এই ‘নতুন দিনে’ বঙ্গবন্ধু নিজের নামে ‘পাকিস্তানের জন্য দুই অর্থনীতি কেন’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটি দশ সপ্তাহ ধরে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পত্রিকাটি বের হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যদি জেলে যান, তাহলে পরিবারের আর্থিক অবস্থা কী হবে তা ভেবে নিউমার্কেটের পাশে একটি কনফেকশনারির দোকান খুলেছিলেন। নাম ‘পূর্বাণী’। এ দোকানেও কবি জুলফিকার বসতেন। দোকানটিতে ‘নতুন দিন’ সাপ্তাহিক বিক্রির জন্য ঝুলিয়ে রাখা হতো। ওয়াইজঘাটের একটি প্রেসে (সম্ভবত নাম ছিল মডার্ন বেঙ্গল প্রেস) পত্রিকাটি ছাপা হতো। বঞ্চিত ও শোষিত পূর্ব পাকিস্তানিদের অবস্থা নিয়ে নতুন দিনে নিয়মিত লেখা বেরোতো। প্রচারসংখ্যাও বাড়ছিল হু হু করে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং নতুন দিন কাগজটির প্রকাশ সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এ ঘটনাটি বঙ্গবন্ধু মনে রেখেছিলেন। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ঢাকার দুটি কাগজ এমন লেখা প্রকাশ করে, যা যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই সহ্য করত না। অবজারভার ছিল স্বাধীনতাবিরোধী হামিদুল হক চৌধুরীর কাগজ। তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ায় কাগজটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। আর দৈনিক বাংলা ছিল সরকারের ট্রাস্টের কাগজ। এ দুই কাগজেই এমন কথা লেখা হয়, যা স্বাধীনতালাভের কয়েকদিনের মধ্যেই সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সরকারের ভিত্তিতে আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধু দুই সম্পাদকের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। একজনকে তার দীর্ঘকালের চাকরির জন্য প্রাপ্য সব টাকা বুঝিয়ে দিয়ে সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে ওই কাগজেরই কলামিস্ট নিযুক্ত করেন। অন্য সম্পাদককে তার সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেন। একই অবস্থা দেখা গেছে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকের বেলায়ও। এই কাগজের সম্পাদকেরও ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কমূলক ভূমিকা। তিনি তার কাগজে লেখেন, ‘একটি আমেরিকান সাপ্তাহিকে খবর দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর পরিবার বিদেশে টাকা পাচার করছে।’ বঙ্গবন্ধু বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। অনুসন্ধানে দেখা গেল, খবরটি মিথ্যা। কোনো বিদেশি কাগজেই এমন খবর ছাপা হয়নি। বঙ্গবন্ধু এ অপরাধে ওই ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তার পত্রিকার প্রকাশও নিষিদ্ধ করেননি। এই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বছরটিতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের দশ বছর পূর্তি তাই বৈশিষ্ট্যমূলক। বঙ্গবন্ধুর এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শে পত্রিকাটি বিশ্বাসী। তাই বলে ‘জো হুজুর’ পত্রিকা নয়। প্রয়োজনে পত্রিকাটি সরকারের ভুলত্রুটি দর্শিয়ে কশাঘাতও যে হানতে পারে তার প্রমাণ পত্রিকাটির কয়েকটি লেখায় পেয়েছি। দেশে পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয় হওয়ায় লন্ডনেও তার একটি ইউরোপীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এবং সেটিও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ সংস্করণটি প্রবাসী বাঙালিদের খবরাখবর প্রকাশ করে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাদের পাশে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এ পত্রিকার সঙ্গে দেশের অনেক বিশিস্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট যুক্ত। আমিও তাদের দলে থাকতে পেরে গর্বিত। লন্ডন, ১৪ মার্চ, শনিবার, ২০২০।

সর্বশেষ খবর